সাদিক আবদুল্লাহ ও শাম্মী আহম্মেদের মনোনয়ন চাওয়া ঘিরে বরিশাল আওয়ামী লীগে উত্তাপ

জাহিদ ফারুক ও সাদিক আবদুল্লাহ (ওপরে)। পঙ্কজ নাথ ও শাম্মী আহম্মেদ (নিচে)
ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বরিশাল সিটির সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। এর মধ্য দিয়ে সাদিক আবদুল্লাহ এবার মনোনয়নযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে।

অন্যদিকে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসন থেকে এবার দলটির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন, তা অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন। দলের কর্মীরা বলছেন, দলের সব পদ হারিয়ে পঙ্কজ নাথ এখন কোণঠাসা। এ অবস্থায় শাম্মীর পাল্লা অনেকে ভারী মনে করছেন।

সাদিক আবদুল্লাহ, নাকি জাহিদ ফারুক

দলীয় সূত্র জানায়, গতকাল রোববার সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসাইন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। তবে অনেক আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এর আগে গত জুনে বরিশাল সিটি নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর চাচা ও নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দেয় দল।

সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থক নেতা-কর্মীরা মনে করেন, আবুল খায়েরের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনে তাঁকে বিজয়ী করার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। যদিও জাহিদ ফারুক ও সাদিক আবদুল্লাহর মধ্যে বিরোধ অনেক পুরোনো। জাহিদ ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মেয়র পদে মনোনয়ন না পাওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহর রাজনৈতিক প্রভাব হুমকির মুখে পড়ে। অবস্থান ধরে রাখতে তিনি সদর আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, জাহিদ ফারুকের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয় গত ঈদুল আজহার পর। ঈদের দিন রাতে হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম)। সাদিক আবদুল্লাহসহ মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেখানে যোগ দিলেও আমন্ত্রণ পাননি জাহিদ ফারুক ও নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ।

দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকে বরিশালে বেশ কিছুদিন ছিলেন না সাদিক আবদুল্লাহ। প্রায় আড়াই মাস পর গত ২২ জুন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে নিয়ে বরিশালে ফেরেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নগরে বিশাল শোভাযাত্রা হয়। সেই আয়োজনে নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ ও তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। এরপর ঈদুল আজহার নামাজ শেষে চাচা খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে কোলাকুলি করলেও সেখানে উপস্থিত প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেননি সাদিক।

জাহিদ ফারুক ও সাদিক আবদুল্লাহ

এ অবস্থায় জাতীয় শোক দিবস ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ সদর আসনে আবার জাহিদ ফারুককে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানান। ওই সভায় জাহিদই প্রধান অতিথি ছিলেন। তাঁরা দুজন ঐক্যবদ্ধভাবে বরিশালের উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

জাহিদ ফারুকের অনুসারীরা আশাবাদী, এবারও এই আসনে তিনিই মনোনয়ন পাবেন। কারণ, গত পাঁচ বছরে এলাকায় তাঁর কোনো বদনাম নেই। দুর্নীতি-অনিয়মেও তাঁর নাম আসেনি।

জাহিদ ফারুকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই জনকল্যাণ হয়, এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন। গত সিটি নির্বাচনে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।’

সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, এখানে যিনি নৌকা পাবেন, তাঁর পক্ষে দল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। দলীয় বিভেদ প্রভাব ফেলবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিটি নির্বাচনেই তো প্রভাব পড়েনি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার জয় নিশ্চিত করতে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও প্রভাব পড়বে না।’

পঙ্কজের আসনে শাম্মী

দলের কেন্দ্রীয় নেতা শাম্মী আহম্মেদ কয়েক মাস ধরেই হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, গণসংযোগ, জনসভাসহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন। দুটি উপজেলা ও একটি থানা কমিটির সব নেতা-কর্মী তাঁর পক্ষে এককাট্টা হয়েছেন। তাঁরা বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে এবার দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।

দলের নেতা-কর্মীরা বলেন, ১৬ অক্টোবর বিকেলে হিজলার কাউরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে কর্মী সমাবেশ হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শাম্মী আহম্মেদ। সেখানে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ এবং কাজীরহাট থানার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সংসদ সদস্য পঙ্কজের নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, ১০ বছরে এলাকায় পঙ্কজ নাথ দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করেছেন। তবে সেখানে উপস্থিত থাকলেও শাম্মী এ বিষয়ে কিছু বলেননি।

পঙ্কজ নাথ ও শাম্মী আহম্মেদ

এ কর্মী সমাবেশের দুই দিন পর পঙ্কজ নাথ মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নে সড়কসহ কয়েকটি উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শাম্মী আহম্মেদের বাবা প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদকে নিয়ে কথা বলেন। মহিউদ্দীন আহম্মেদ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। ওই সময় পঙ্কজ নাথ বলেছিলেন, এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদের সহযোগীরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করেন। এখন তাঁরাই মেহেন্দীগঞ্জে আওয়ামী লীগ করছেন।

শাম্মী আহম্মেদের পক্ষের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান বলেন, ‘শাম্মী আহম্মেদ দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। আমরা আশাবাদী তিনি মনোনয়ন পাবেন। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের দাবি এটা। এলাকায় দল ও জনগণ এখন আর তাঁকে (পঙ্কজ নাথ) চায় না।’

কামাল খান আরও বলেন, দলের সব পদ হারিয়ে এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পঙ্কজ নাথ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এখন দিকশূন্য হয়ে পড়েছেন। নানা বেফাঁস মন্তব্য করছেন। পঙ্কজ গত ১০ বছরে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করেছেন। দুটি উপজেলা ও আটটি ইউনিয়নের দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করিয়েছেন। গত ১০ বছরে তাঁর অন্যায়-অত্যাচারে অন্তত ১১ জন খুন হয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীরা এর থেকে মুক্তি চান।

তবে পঙ্কজ নাথ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বলে দাবি করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সুভাষ চন্দ্র সরকার। তাঁর দাবি, দলীয় কিছু নেতা-কর্মীরা সংসদ সদস্যের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বিরোধিতা করছেন। তবে এলাকার জনসমর্থন পঙ্কজ নাথের পক্ষে। দলীয় মনোনয়ন পেলে এবারও তিনি বিজয়ী হবেন।