বগুড়া সদর উপজেলার বথুয়াবাড়ি গ্রামের হিন্দুপাড়া। সেখানকার অধিকাংশ পুরুষ পান ব্যবসায়ী। কেউ পান বিক্রি করতে গিয়েছিলেন হাটে, কেউ খেতের কাজে মাঠে। হঠাৎ ওই পাড়ায় হানা দেয় একদল লোক। কারও হাতে লাঠি–রড, আবার কারও হাতে ধারালো অস্ত্র। হিন্দুপাড়ার নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকেন। এ ঘটনা ৫ আগস্ট বিকেলের।
ওই দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বগুড়া শহরসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল বের করা হয়। একপর্যায়ে সদর উপজেলার বথুয়াবাড়ির হিন্দুপাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে তিনটি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। আওয়ামী নেতা উজ্জল চন্দ্রের নির্মাণাধীন বাড়ির পূজার ঘর তছনছ করা হয়। ইটপাটকেলের আঘাতে একটি বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে যায়। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কীর্তনীয়া পুষ্প রানী দাস (৪২)। তাঁর বাড়িঘরের আসবাব ও মাইক্রোবাস ভাঙচুর এবং জিনিসপত্র লুট হয়েছে। ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন বথুয়াবাড়ির হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা।
গত শনিবার বগুড়া সদর উপজেলার লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের বথুয়াবাড়ি গ্রামে কীর্তনীয়া পুষ্প রানী দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটকের পাশে মাইক্রোবাস রাখার গ্যারেজ। গ্যারেজের ফটকে হামলার ক্ষতচিহ্ন। গ্যারেজে ভেতরে ভাঙচুর করা একটি মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের সামনে–পেছনেসহ সব কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্যারেজের পাশেই রান্নাঘর, শৌচাগার। সব ভেঙে লন্ডভন্ড। শয়নকক্ষে কিছু পুরোনো আসবাবের ভাঙা কাচ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুষ্প রানী দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেলবেলা। সময় আনুমানিক পাঁচটা হবে। হঠাৎ বহু মানুষের হইচই। পাড়ার লোকজন বলাবলি করছিল, হাজারো লোকজন লাঠিসোঁটা, রড, দেশি অস্ত্র হাতে এ পাড়ায় আসছে বাড়িঘর লুট করতে। পাড়ার লোকজন সব ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। আমিও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেটাকে নিয়ে প্রাণভয়ে ছুট দিলাম। ফসলের মাঠে এক হাঁটু জল। সেই জল ভেঙে গ্রামের পেছন দিয়ে অন্য পাড়ায় আশ্রয় নিই।’ ওই দিন তাঁর স্বামী অনন্ত চন্দ্র দাস বাড়িতে ছিলেন না।
এসে দেখি, আমার সবই শ্যাষ। মাইক্রোবাসটা ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। বসতঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে ঘরের আলমারিতে থাকা নগদ টাকা ও সোনার গয়না।পুষ্প রানী দাস, বথুয়াবাড়ির হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা
হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফেরেন পুষ্প রানী দাস। তিনি বলেন, ‘এসে দেখি, আমার সবই শ্যাষ। মাইক্রোবাসটা ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। বসতঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। লুট করা হয়েছে ঘরের আলমারিতে থাকা নগদ টাকা ও সোনার গয়না। গোটা বাড়িজুড়ে ধ্বসলীলার চিহ্ন।’
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুষ্প রানী দাস। তিনি বলেন, ‘কারও সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। কোনো দলও করি না। বিয়ের আগে বাবার বাড়ি (শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের পাকুরিয়া) থেকেই লীলাকীর্তন গাইতাম। স্বামীর বাড়িতে আসার পর ২৬ বছর ধরে লীলাকীর্তনের দল নিয়ে গাইতে যাই। উপার্জনের টাকায় ২০ লাখ টাকায় হাইয়েচ মাইক্রোবাস কিনেছি। বিঘা তিনেক আবাদি জমি কিনেছি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বাড়ি করেছি। সবই পরিশ্রমের টাকায়। আমার অপরাধ কী? আমি তো কারও কোনো ক্ষতি করিনি। আমার বসতঘরে কেন হামলা হলো?’
পুষ্প রানী দাসের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি বকুল বালা (৮০)। হামলার খবর পেয়ে তিনিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। বকুল বালা বলেন, ‘হামরা তো এ দেশেই মানুষ, এখন তো পরাধীন নয়। হামরা কেন আবার মানুষের শত্রু হলাম? হামার বেটার কী দোষ, বাড়িত ক্যান হামলা হলো? গাড়ি-বাড়ি ভেঙে লন্ডভন্ড করা হলো? হামলার ভয়ে হামার ছলডা (অনন্ত) এখনো পালিয়ে বেড়াচ্চে।’
বাথুয়াবাড়ি গ্রামের সুজিত চন্দ্র দাসের স্ত্রী সঞ্চিতা রানী দাস (৫০) বলেন, ‘হামলার দিন বাড়িতই লুকিয়ে আচনু। সগলির হাতত লাঠি, রড, ধারালো অস্ত্র। পাড়াত ঢুকেই তারা এলোপাতাড়ি বাড়িঘরে ইটপাটকেল ছুড়ে থাকে। সগলির বসতঘরের দরজা বন্ধ ছিল। হামলাকারীরা দরজাত লাথি দিতে থাকলে আতঙ্কে হামাকেরে প্রাণ যায় যায়। এরপর কয়েকজন কীর্তনীয়া পুষ্প রানী দাসের বাড়ি খুঁজতে থাকে। বাড়ির দরজা ভাঙে ঘরের ভিতরে ঢুকে তাঁর স্বামীকে খুঁজতে থাকে।’
বাথুয়াবাড়ি গ্রামের রণজিৎ চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন (৫ আগস্ট) হাজারখানেক মানুষ এ পাড়ায় চড়াও হয়। এ পাড়ার উজ্জল চন্দ্র আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বগুড়া শহরে থাকেন। সদর আসনের এমপি (সাবেক) রাগেবুল আহসানের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর। হামলাকারীরা প্রথমে উজ্জলের বাড়িতে চড়াও হয়। সেখানে কিছু ভাঙচুর করে। উজ্জলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে পুষ্প রানী দাসের স্বামী অনন্ত চন্দ্র দাসের। সরকারি অনুদান, সাহায্য–সহযোগিতা এলে অনন্ত চন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে উজ্জল তা বিতরণ করতেন। হামলাকারীরা উজ্জলকে না পেয়ে অনন্ত চন্দ্রের বসতবাড়িতে হামলা করে। তাঁর মাইক্রোবাস ভেঙে চুরমার করে। বসতঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
উজ্জলের বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন উজ্জল চন্দ্র। তাঁর ভাই পরিতোষের স্ত্রী শিখা রানী প্রথম আলোকে বলেন, উজ্জলের বাড়িতে পাকা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তেমন কিছু না পেয়ে হামলাকারীরা বাড়ির পূজার ঘরের প্রতিমা ভাঙচুর করে। সেই দৃশ্য ভিডিও করায় মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে যায়। দুদিন পর ফোন ফেরত দিয়েছে।
ওই ঘটনার পর জেলা প্রশাসন বা পুলিশের কেউ ঘটনাস্থলে যায়নি। বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরেজমিন তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।