মজুরি বাড়ানোর দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের চলমান আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছে। গতকাল সোমবার গাজীপুরে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। একাধিক কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় আহত রাসেল হাওলাদার (২২) ও ইমরান (৩০) নামের দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বিক্ষোভ ও কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে সাভার ও আশুলিয়ায়ও। এসব ঘটনায় ৮০ জনের বেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরই মধ্যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছেন শ্রমিকেরা।
পুলিশ ও শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ১০টার দিকে গাজীপুরের চান্দনার ভোগড়া এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শ্রমিকেরা। একপর্যায়ে তাঁরা ১৫-১৬টি বাস ও ট্রাক ভাঙচুর করেন। কলম্বিয়া গার্মেন্টস নামের একটি কারখানার সামনে থাকা একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
এ সময় থানা ও শিল্প পুলিশ শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। শ্রমিকেরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এতে কমপক্ষে প্রায় ৬০ জন শ্রমিক আহত হন।
আহত শ্রমিকদের মধ্যে রাসেল হাওলাদারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি ঝালকাঠি সদর উপজেলার হান্নান হাওলাদারের ছেলে।
বিকেলে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বেলা একটার দিকে আমরা একজন শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদ পাই। চিকিৎসক আমাদের জানিয়েছেন, হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে বেলা পৌনে একটার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু বিকেলে শ্রমিক নিহত হওয়ার খবরে কোনাবাড়ী এলাকায় আবারও শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কোনাবাড়ী এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভের সময় পাশেই অনন্ত গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় আগুন দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৫০-৬০ জন যুবক কারখানার ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। পরে আগুন দিয়ে পালিয়ে যান। আগুন নেভার পর ইমরান নামে এক শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামের ভূমবাড়িয়ায়।
গাজীপুর মহানগরীর বাসন সড়ক এলাকার কলম্বিয়া কারখানার শ্রমিক হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মাসে আট হাজার টাকার মতো বেতন দেওয়া হয়। সন্তানসহ তিনজনের সংসারে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। বাকি টাকায় সংসার চালানো যায় না। তাই বেতন ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা করার দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা হওয়ার আগে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান।’
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের মজুরি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু কিছু লোক শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে।
একই দাবিতে ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায়ও বিক্ষোভ হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা। একপর্যায়ে একটি কারখানার ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে হামলা চালানো হয়। এতে কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
এ ছাড়া সাভারের হেমায়েতপুরে পদ্মার মোড় এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পোশাকশ্রমিকেরা। পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।