নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেলে না চিকিৎসাসেবা 

পাঁচটি গ্রামে ১৫ হাজার বাসিন্দার জন্য সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। নেই ওষুধের দোকানও।

প্রতীকী ছবি

ধলেশ্বরী নদীর তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি গ্রাম। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায়  গ্রামগুলো রাজধানীর কাছে হয়েও যেন অনেক দূরে। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ–সুবিধা। এখানে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক নেই।  এ কারণে কেউ অসুস্থ হলে দুর্ভোগের শেষ থাকে না। এমন বিচ্ছিন্নতার কারণে গ্রামগুলো পরিচিতি পেয়েছে কেরানীগঞ্জের ‘ছিটমহল’ হিসেবে।

গ্রামগুলো হলো চর চামারদহ, চর খাড়াকান্দি, হোগলাগাতি, নতুন মধুরচর ও দক্ষিণ ঢালিকান্দি। পাঁচটি গ্রামে থাকার মধ্যে আছে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কিন্তু এত বছরেও হয়নি কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গ তুলতেই হতাশা প্রকাশ করে নতুন মধুরচর গ্রামের গৃহবধূ রাহেলা খাতুন বলেন, ‘আমগো পাঁচ গ্রামে কুনো হাসপাতাল নাই। আমগো মা-বইনেরা গর্ভবতী হইলে বড় সমস্যায় পড়তে অয়। পেডের বাচ্চা আর মায়ের জীবন লইয়া অনেক ঝুঁকি থাহে। রোগবালাই অইলে ধলেশ্বরী নদী পার হইয়া হাসপাতালে যাইতে অয়। আমগো দেহার কেউ নাই। আল্লাহই আমগো একমাত্র ভরসা।’

কেরানীগঞ্জের ‘ছিটমহল’ বলে খ্যাত গ্রামগুলোর মধ্যে চর চামারদহ পড়েছে উপজেলার কলাতিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে। ৫  নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে চর খাড়াকান্দি এবং হজরতপুর ইউনিয়নে হোগলাগাতি, নতুন মধুরচর ও দক্ষিণ ঢালিকান্দি গ্রাম। এসব গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। সেখানকার বাসিন্দারা জানালেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত।

চর চামারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহিদা খাতুন বলেন, এখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগী ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঝড়–বৃষ্টির দিনে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। গ্রামে হাসপাতাল না থাকায় অনাগত শিশু ও প্রসূতির জীবন ঝুঁকিতে থাকে। বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত।’

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রামগুলোর রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব নাজুক। নেই কোনো সরকারি বা কমিউনিটি ক্লিনিক। বেসরকারি পর্যায়েও নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। এমনকি নেই কোনো ওষুধের দোকানও। চার–পাঁচটি মুদিদোকান রয়েছে গ্রামগুলোতে, সেখানে সাধারণ কিছু বড়ি ও খাবার স্যালাইন বিক্রি করা হয়। এখানকার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিতে ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলাতিয়া ও হজরতপুর ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নিজের পরিবারের সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৮০)। তিনি জানান, ১৪–১৫ দিন আগে তাঁর ছেলের বউয়ের পা ভেঙে গিয়েছিল। তখন অনেক কষ্ট করে তাঁকে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।

এত বছর পরও ওই পাঁচ গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে কলাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহের আলী বলেন, ওইসব গ্রামের মানুষ প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাঁদের দুঃখকষ্টের কথা চিন্তা করে শিগগিরই স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা উচিত।

এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে অতিসত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কাজী আরাফাতুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কমপক্ষে ছয় হাজার মানুষের সেবার জন্য একটি সরকারি স্যাটেলাইট কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের নিয়ম রয়েছে। সে হিসাবে ধলেশ্বরী নদীর তীরে পাঁচ গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অবশ্যই সেখানে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকা দরকার।

হোগলাগাতি গ্রামের বাসিন্দা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলেন, ‘মানুষের মৌলিক পাঁচটি অধিকারের অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের গ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবার যে অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের সেই অধিকার নেই। দেশের অন্যান্য গ্রামের মানুষ যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, আমরা সেসব পাচ্ছি না।’