স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হবেন। এসএসসি পাস করে পলিটেকনিক্যালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক টানাটানিতে পড়ালেখার ইতি টানতে হলো। বিয়ের পর মাটির ব্যাংকে জমানো শুরু করলেন খুচরা টাকাপয়সা। করোনার ঘরবন্দী সময়ে সঞ্চয়ের সেই আট হাজার টাকা হয়ে গেল বড় মূলধন। সে টাকায় অনলাইনে শুরু করলেন মসলার ব্যবসা। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের ফেরদৌস আকতার এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। প্রতি মাসে এক লাখ টাকার মতো মসলা বিক্রি করেন তিনি।
পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামে মেয়ে মাশরুবা বারী (১৫) ও ছেলে সামিউল বারীকে (৭) নিয়ে থাকেন ফেরদৌস আক্তার। তাঁর স্বামী লুৎফুর বারী পারভেজ গ্রামে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। মেয়ে মাশরুবা নবম শ্রেণিতে পড়ে। গত সোমবার সন্ধ্যার দিকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে জানা গেল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।
ফেরদৌস বলেন, ‘২০১৬ সালটা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের। মেয়েকে পাশের উপজেলার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করাই। বাড়ি থেকে আমি তাকে নিয়ে যাওয়া-আসা করতাম। ক্লাস চলাকালে স্কুলে বসে অপেক্ষা করতে হতো। তখন ফেসবুকে দেশে নারী উদ্যোক্তাদের বড় সংগঠন ‘উই’–এর গ্রুপটি পেয়ে যাই।’
মূলত তখন থেকেই ফেরদৌসের ব্যবসার পরিকল্পনা মাথায় আসে। করোনার সময়টাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নেমে পড়েন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। ফেরদৌস বলেন, ‘২০২০ সালে করোনার কারণে মানুষ যখন ঘরবন্দী, তখন ওই সময়টাকে আমি কাজে লাগাই। মাটির ব্যাংকে জমানো আট হাজার টাকা দিয়ে গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে মরিচ, ধনে, হলুদ কিনে শুকিয়ে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। ‘কুক মাসালা’ নামের একটি ফেসবুক পেজও খুলি তখন। উই গ্রুপ ও ফেসবুক পেজে মসলা কেনা থেকে শুরু করে ধোয়া, শুকানো, ভাঙানো ও মোড়কজাত করার ভিডিও আপলোড দিই। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফেসবুক কমেন্ট বক্সে ও ইনবক্সে অর্ডার আসতে থাকে। প্রথম দিনে ছয়জন মরিচের গুঁড়ার অর্ডার দেন। পরের ২২ দিনে আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতি মাসে লাখখানেক টাকার পণ্য বিক্রি হয়। একসময় অনেকে আমাকে মসলাওয়ালি, ফেরিওয়ালি বলত। তারা এখন আমার কাছ থেকে ব্যবসার পরামর্শ নেয়।’
ফেরদৌস আকতারের বসার ঘরের এক কোণে সারি করে সাজানো পুরস্কার আর সনদ। ২০২১ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে তাঁকে জয়িতা পুরস্কার দেওয়া হয়। চলতি মাসে উদ্যোক্তাদের গ্রুপ উই থেকে বিজনেস অব দ্য ইয়ার ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন জয়ী পুরস্কার। সারা দেশের ১৪ লাখ উই উদ্যোক্তা সদস্য থেকে ২০ জনকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। পুরস্কার তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
একেবারেই সাদামাটা গৃহিণীর জীবন ছিল তাঁর। এখন সারা দিন ফেসবুকে পণ্যের অর্ডার নেওয়া, মোড়কজাত করে কুরিয়ারে পৌঁছে দেওয়া—এসব তদারকি করে দিন কাটে। সারা দেশে তাঁর নিয়মিত ক্রেতা ৫০০ জনের ওপর। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার গ্রাহকের কাছে অন্তত ৪০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন তিনি। ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার হয় বলে জানান ফেরদৌস। তাঁর গ্রাহকদের মধ্যে হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচের গুঁড়ার চাহিদা বেশি। এ ছাড়া হলুদ, ধনে, মেজবানি মসলা, বিরিয়ানি মসলা, মাংসের মসলা, জিরা, বিন্নি চাল, শিমের বিচি, আতপ চালের গুঁড়াও বিক্রি করেন তিনি। তবে স্থানীয়ভাবে কুরিয়ার না থাকায় চট্টগ্রাম নগরে গিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে হয় তাঁকে। এ জন্য তাঁর খরচ বেশি পড়ে। এই খরচ তিনি ক্রেতার কাছ থেকে নিতে পারেন না। ভবিষ্যতে ‘কুক মাসালা’ নামের একটি কারখানা করতে চান ফেরদৌস।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে ফেরদৌস আকতার বলেন, সফল উদ্যোক্তা হতে চাইলে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কে কী বলল সেটা না ভেবে নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে হবে।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বজন কুমার তালুকদার বলেন, নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ফেরদৌসের মতো উদ্যোগী হতে হবে। ইচ্ছাশক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। ফেরদৌস আকতার তার প্রমাণ।