কয়রা উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি অরবিন্দ মন্ডলের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সম্প্রতি উপজেলার গড়িয়াবাড়ি গ্রামে
কয়রা উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি অরবিন্দ মন্ডলের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সম্প্রতি উপজেলার গড়িয়াবাড়ি গ্রামে

কয়রায় বাড়িতে হামলা, ঘেরের মাছ লুট, আওয়ামী লীগের অনেকে আত্মগোপনে

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খুলনার কয়রায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। লুট করা হয় মাছের ঘের। ঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় নৈরাজ্য ও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। গত শনিবার থেকে প্রশাসনের তৎপরতা শুরুর পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করে। তবে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও উপজেলা পরিষদের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি এলাকাছাড়া হওয়ায় তাঁরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন।

৫ আগস্ট বিকেলে কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসীন রেজার বাড়িতে হামলা করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন হামলা হয় উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও কয়রা সদর ইউপির চেয়ারম্যান বাহারুল ইসলামের বাড়িতে। এ ছাড়া আমাদি, বাগালি, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউপির চেয়ারম্যানের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া গিলাবাড়ি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা কফিল উদ্দিন, মহেশ্বরীপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিজয় কুমার, ইউপি সদস্য শামীম হোসেন, কালিকাপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম ইব্রাহিম, আওয়ামী লীগ নেতা আনসার আলী, কয়রা সদর ইউনিয়নের স্কুলশিক্ষক অরবিন্দ মণ্ডল ও সুজিত মণ্ডলের বাড়িতেও হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

গত বুধবার সকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহসিন রেজার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে কালচে হয়ে গেছে দোতলা বাড়িটি। পুড়ে গেছে ঘরের আসবাব। মোহসিনের ছোট ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। ৫ আগস্ট ঘরের বারান্দায় ভাইয়ের লাশ পড়ে ছিল। কোনোমতে পানি দিয়ে আগুনের তাপ কমিয়ে লাশ বের করে এনেছিলাম। পরিবারের সবাই কয়রার গোবিন্দপুর গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে থাকছি।’

সদর ইউপির চেয়ারম্যান বাহারুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দ্বিতল বাড়ির প্রতিটি কক্ষে আগুন দেওয়া হয়েছে। ঘটনার এত দিন পরেও কক্ষে আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের স্তূপ দেখা গেল। প্রতিটি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাচের টুকরা। বাড়ির নিচে একটি প্রাইভেট কারের কঙ্কাল দেখা গেল।

বাহারুলের এক প্রতিবেশী জানান, ৫ আগস্ট বিকেলে রাস্তায় মিছিলের শব্দ শুনে জানালা দিয়ে দেখেন, কয়েক শ লোক চেয়ারম্যানের বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। তারা প্রথমে নিচে থাকা গাড়িতে আগুন দেয়। এরপর ঘরে ঢুকে লুটপাট চালায়। আসবাব নিয়ে যায় কেউ কেউ। এরপর চলে যায়। পরে আবার একটি মিছিল এসে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই থেকে চেয়ারম্যানের পরিবারের কারও খোঁজখবর নেই। ফোনও বন্ধ।

মহেশ্বরীপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিজয় কুমারের বাড়িতে গিয়ে দোতলা বাড়িটিরও একই অবস্থা দেখা গেল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ৬ আগস্ট সকালে বিএনপি-জামায়াতের লোক লাঠিসোঁটা, রড, পেট্রল নিয়ে আমার বাড়িতে হামলা করে। গেটের তালা ভেঙে প্রথমে লুটপাট করে। এরপর ঘরের আসবাব এক জায়গায় করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা তখন কেউ বাড়িতে ছিলাম না। খুব ভয়ে আছি। কবে বাড়ি ফিরতে পারব, জানি না।’

৫ আগস্ট বিকেলে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মোহসীন রেজার বাড়িতে হামলা করে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিশিত রঞ্জন মিস্ত্রি অভিযোগ করে বলেন, গত এক সপ্তাহে উপজেলার অন্তত অর্ধশত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। হামলাকারীরা সবাই বিএনপি-জামায়াতের লোক। তাঁরা আওয়ামী লীগের নেতাদের তালিকা করে ঘেরের মাছ লুট করেছেন।

কয়রা সদরের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের বিনয়, সন্তোষ, সুশান্ত, তাপস ও শুবোল বর্মণের বাড়িতেও হামলা, লুটপাট হয়েছে। সন্তোষ বর্মণ বলেন, লুটেরার দল সবকিছু নিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, হাঁস-মুরগিও লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।

কয়রা উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি অরবিন্দ মণ্ডল বলেন, ‘আমার বাড়িতেও লুটপাট করা হয়েছে। উপজেলার হিন্দুদের অন্তত ৩৫টি বাড়িঘর ও ১১টি দোকানপাটে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে।’ তাঁর দাবি, হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৩০ জন ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তাঁরা এখনো এলাকায় ফেরেননি।

কয়রার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ১০টি পরিবারের লোকজন বাড়িতে ফেরেননি। তাঁদের বাড়িঘর আপাতত প্রতিবেশীরা দেখভাল করছেন। চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে রাতে পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন। এলাকাছাড়া ও হামলার শিকার বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব নুরুল আমিন বলেন, ‘এলাকায় যারা নৈরাজ্য ও অরাজকতা করেছে, তারা বিএনপির কেউ না। এরা সুযোগসন্ধানী। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছে। প্রতিদিন আমরা মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক করেছি। যেসব এলাকায় সমস্যা আছে, সেসব এলাকার দলের নেতা-কর্মীদের বিশৃঙ্খলাকারীদের রুখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় পাহারা দেওয়া হচ্ছে।’

জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা আমির মাওলানা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বন্ধে সব সময় সোচ্চার জামায়াত। দলের নেতারা এলাকার বিশৃঙ্খলা রুখতে প্রথম দিন থেকেই কাজ করছেন।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তারিক উজ জামান বলেন, এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। সংকট দ্রুতই কেটে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।। গত শনিবার থেকে কোস্টগার্ড ও পুলিশ যৌথভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ শুরু করেছে।