গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির সামনে নিজেদের স্কুলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বাগানবাড়িটি ময়মনসিংহ নগরে ‘লোহার কুটির’ নামে পরিচিত। ১৮৭৯ সালে নির্মিত এই লোহার কুটির ময়মনসিংহের অন্যতম সমৃদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র। সম্প্রতি ময়মনসিংহের গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির সামনে নিজেদের স্কুলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ের সামনের সড়ক দিয়ে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা এ সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করছে। তবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে ময়মনসিংহের সুশীল সমাজ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগরের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, লোহার কুটির ঘিরে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে ঘিরে একটি বড় সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। এরপর আবার নতুন সীমানাপ্রাচীর করে স্কুলকে আলাদা করা হলে ঐতিহ্যবাহী লোহার কুটিরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ হারাবে।
লোহার কুটির মূলত বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা বিশেষ একটি ভবন। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী এটি বাগানবাড়ি হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন। ময়মনসিংহ শহরের জুবিলি উৎসব উদ্যাপনের জন্য তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের পত্নী আলেকজান্দ্রার নামে ভবনটির নাম করা হয় ‘আলেকজান্দ্রা ক্যাসল’।
তবে স্থানীয়ভাবে ভবনটিকে লোহার কুটির বলা হয়। মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বিদেশি অতিথিদের থাকার জন্য এটি ব্যবহার হতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহে এসে ভবনটিতে থেকেছেন। ভারত থেকে চন্দন কাঠ এনে নির্মাণ করা এ ভবন বসবাসের জন্য বিশেষ আরামদায়ক ছিল।
জমিদারি প্রথা উঠে গেলে ১৯৪৮ সালে এই বাগানবাড়ির সীমানায় প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। পরে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ল্যাবরেটরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল। বর্তমানে এই সীমানার ভেতর রয়েছে সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ২৭ দশমিক ১৫ একর জমির মধ্যে একটি সীমানাপ্রাচীরের ভেতর সাতটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এই জমি এখনো খাসজমি।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমানা বেগমের অভিযোগ, সাতটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও একমাত্র তাঁদের স্কুলেই
রয়েছে ছোট ছোট শিক্ষার্থী। সাতটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কটি দিয়ে বেপরোয়াভাবে চলে মোটরসাইকেল। এতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা থাকে না। এ ছাড়া রাতে স্কুলের পেছনে মাদকাসক্তদের আড্ডা হয়। যে কারণে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কর্তৃপক্ষের মতামত নিয়েই সীমানাপ্রাচীরটি করা হচ্ছে। গত বুধবার থেকে এই সীমানাপ্রাচীরের কাজ শুরু হয়েছে।
গতকাল রোববার দেখা যায়, লোহার কুটিরের সামনে স্কুলের মাঠবরাবর ইটের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। তবে সে ইটের গাঁথুনি এখনো বেশি উঁচু হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, এ সাতটি প্রতিষ্ঠান ঘিরে যে সীমানাপ্রাচীর, তার দুই প্রান্তে দুটি ফটক রয়েছে। একটি ফটক ময়মনসিংহ নগরের বাতিরকল প্রান্তে। আর অপরটি নগরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা প্রান্তে। ওই দুটি এলাকার মানুষ জানান, দুটি ফটকই দিনের বেলায় খুব ছোট করে খোলা থাকে। এতে মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে না। তবে কখনো কখনো অসতর্কতার কারণে মোটরসাইকেল প্রবেশ করে। তবে বর্তমানে ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কটির সংস্কারকাজ চলায় মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে গতকাল দুপুরে কথা হয়। তাঁরা জানান, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সমন্বয় না করেই সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। এমনকি এ কাজ খুব গোপনে শুরু হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসগুলো ছুটি হয়ে যাওয়ার পর সীমানাপ্রাচীরের ইটের গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে।
টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ মো. জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘সাতটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এত বড় আর ঐতিহ্যবাহী মাঠটিকে সীমানাপ্রাচীর করে ভাগ করে নেওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা। আমরা কখনো সীমানাপ্রাচীরের পক্ষে মত দিইনি। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাচীর নির্মাণ করতে চাইলে আমি বলেছি সড়কটির ওপর তিনটি ইটের গাঁথুনি অথবা মোটা করে গতিরোধক করা যেতে পারে। কখনোই সীমানাপ্রাচীর নয়। আমার কথা না মেনে প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলতে থাকলে বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। আপাতত স্কুল কর্তৃপক্ষকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। পরে এই সীমানায় অবস্থিত সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা হবে।’