বন্যার কারণে অনেকে গবাদিপশু এনে বেঁধে রেখেছেন সড়কে। আজ দুপুরে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নৈনগাঁওয়ে
বন্যার কারণে অনেকে গবাদিপশু এনে বেঁধে রেখেছেন সড়কে। আজ দুপুরে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নৈনগাঁওয়ে

সুনামগঞ্জে বন্যায় গবাদিপশু নিয়ে মানুষের ভোগান্তি

কৃষক আবদুর রশিদের (৫২) পরিবারে ছয়জন সদস্য। ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে গত সোমবার রাতে। গ্রামের একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু বাড়ির পাঁচটি গরু নিয়ে চিন্তায় পড়েন। এক দিন সেগুলো গোয়ালে হাঁটুপানির মধ্যে ছিল। পরে গ্রামের আরেক ব্যক্তির বাড়ির উঠানে বেঁধে রেখেছেন।

আবদুর রশিদ বলছিলেন, ‘মানুষের দিনকালই বড় দুর্ভোগে যাচ্ছে। থাকা, খাওয়ার কোনো উপায় নেই। এ অবস্থায় ঘরের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে চরম বিপাকে অনেকেই।’

আবদুর রশিদের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে। তাঁর মতো অনেকেই গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। নিজেরা কোথায় থাকবেন? কী খাবেন? এর সঙ্গে আছে গবাদিপশু রক্ষার চিন্তা।

একই গ্রামের বাসিন্দা ইসলাম নূর জানান, তাঁরা পাঁচজন মিলে ১৭টি গরু, ৪টি ছাগল গ্রামের আরেক বাসিন্দা সালাহ উদ্দিনের বাড়ির উঁচু জায়গায় এনে বেঁধে রেখেছেন। বাড়িতে থাকা গোখাদ্য বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। একদিকে নিজেদের খাবার জোগাড় করার কষ্ট; অন্যদিকে আছে গবাদিপশু। সব দিক থেকেই সমস্যায় আছেন তাঁরা।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে পার্শ্ববর্তী হাসননগর এলাকার বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ সঙ্গে করে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি নিয়ে এসেছেন। এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, তাঁর তিনটি গরু ও দুটি ছাগল আছে। প্রথমে নিজেরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। পরে গবাদিপশু নিয়ে এসেছেন। মকবুল বলছিলেন, ‘খালি আমরা বাঁচতাম, ইটা ঠিক না। এর লাগি গরু-ছাগলও নিয়া আইছি। তবে অনেকে বাড়িত রাখছে।’

তবে যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসেননি, অথচ গবাদিপশু আছে, তাঁরা সেগুলো উঁচু জায়গা, সড়কের ওপর বেঁধে রেখেছেন। চারদিকে পানি থাকায় গোখাদ্য সংগ্রহে সংকট রয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার নৈনগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আশিকুর রহমান জানান, তাঁদের গ্রামের অনেকের ঘরে পানি। কেউ কেউ গবাদিপশু রাস্তার উঁচু জায়গা ও সেতুর ওপর রেখেছেন। সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা আলম নূর জানান, তাঁরা গবাদিপশু সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের উঁচু জায়গায় পলিথিনের মাচা বেঁধে তার নিচে রেখেছেন।

অনেকের বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। অন্যের উঠানে গবাদিপশু এনে বেঁধে রেখেছেন তাঁরা। আজ সকালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৭টি গরু, ৪৯ হাজার ৮৯১টি ছাগল, ২১ হাজার ১১২টি মহিষ, ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৮টি ভেড়া, ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৪টি হাঁস, ২৭ লাখ ৩০ হাজার ৪৪২টি মুরগি, ৪১ হাজার ২৫০টি কবুতর আছে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষ এমনিতেই সমস্যায় আছেন। এ অবস্থায় যাদের ঘরে গবাদিপশু আছে, তারা স্বাভাবিকভাবে একটু বেশি সংকটে পড়েছেন। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমরা ক্ষয়ক্ষতির খোঁজ নেব এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহোযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করব।’

রাতে বৃষ্টি হয়নি, বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত
সুনামগঞ্জে গতকাল বুধবার রাতে ভারী বৃষ্টি না হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি অনেকটা স্থির হয়ে আছে। জেলার নিচু এলাকার কোথাও কোথাও পানি সামান্য বেড়েছে। জেলা ছাতক, সদর, দোয়ারাবাজার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পরিস্থিতি উন্নতি হবে, এমন আশা করছেন লোকজন। শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, মধ্যনগর ও জামালগঞ্জ উপজেলায় কিছুটা পানি বেড়েছে। ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে বেশি। পাহাড়ি ঢল নেমে প্রথমেই আঘাত হানে এই দুই উপজেলায়। ছাতক এক সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত। এ উপজেলার সব ইউনিয়ন ও পৌরসভা প্লাবিত।

জেলায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৭টি গরু, ৪৯ হাজার ৮৯১টি ছাগল, ২১ হাজার ১১২টি মহিষ, ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৮টি ভেড়া, ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৪টি হাঁস, ২৭ লাখ ৩০ হাজার ৪৪২টি মুরগি, ৪১ হাজার ২৫০টি কবুতর আছে।

সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কিছু স্থানে বন্যার পানি উঠলেও যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে জেলার ছাতক-সিলেট সড়ক, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক, সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর সড়ক প্লাবিত হওয়ায় এসব সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে।

জেলার ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৭০ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত বলে জেলা প্রশাসন দাবি করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা বলেছেন, পুরো জেলাই বন্যাকবলিত। লাখো মানুষ পানিবন্দী। অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ।

সুনামগঞ্জ শহরের সব জায়গায় এখনো পানি রয়েছে। পানি আছে মানুষের বসতঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। যাঁদের বসতঘরে পানি, তাঁরা আছেন বেশি কষ্টে। অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউবা পরিবার নিয়ে উঠেছেন হোটেল। আবার কেউ কেউ আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি, উজানের ঢলও নেমেছে কম। তাই সুরমা নদীর পানি কোনো কোনো স্থানে কমেছে। তবে আজ ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
মামুন হাওলাদার, নির্বাহী প্রকৌশলী, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। ছাতক উপজেলা সদরে সুরমা নদীর পানি ১২৯ সেন্টিমিটার, দিরাইয়ে ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা) বৃষ্টি হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও গতকাল কম বৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, উজানের পাহাড়ি ঢলের সমস্যা হয় বেশি। ঢল সামলে পানি বাড়ে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি, উজানের ঢলও নেমেছে কম। তাই সুরমা নদীর পানি কোনো কোনো স্থানে কমেছে। তবে আজ ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।