কাকের সঙ্গে বেশ সখ্য রাজশাহীর পবা উপজেলার বেলঘরিয়া গ্রামের নেকবরের
কাকের সঙ্গে বেশ সখ্য রাজশাহীর পবা উপজেলার বেলঘরিয়া গ্রামের নেকবরের

নেকবরের সঙ্গে কাকের সখ্য, থাকে পাশে-কাঁধে

সাত–আট মাস আগের কথা। ভরদুপুরে ঝড়বৃষ্টি। নেকবর (৪২) পাশের বাজার থেকে ফিরে এলেন বাড়িতে। কী মনে করে যেন আবার গেলেন। দেখলেন চোখ না–ফোটা এক কাকের ছানা পড়ে আছে মাটিতে। একবার নিতে চাইলেন তুলে, আবার চাইলেন না। ছানাটির মাকে না দেখে মায়া হলো খুব। নিয়ে এলেন। সেই থেকে কাকটি নেকবরের কাছে। রাত-দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁর পাশে থাকে। তিনি কাকটিকে খাবার তুলে দেন, কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি এখন ‘কাকপোষা নেকবর’ হিসেবে পরিচিত এলাকায়।

নেকবরের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌর এলাকা বেলঘরিয়া গ্রামে। স্ত্রী রাখি আক্তার, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। নেকবর পেশায় নরসুন্দর। বেলঘরি বাজারে তাঁর সেই দোকান। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁর দোকান খোলা থাকে। দিনের বেলায় চুল কাটান কম।

মঙ্গলবার সকালে বেলঘরিয়া বাজারে গিয়ে নেকবরের বাড়ির সন্ধান করতেই লোকজন বলে ওঠেন, ‘কাকপোষা নেকবর’ কি না। পরে তাঁরাই বাড়িটি চিনিয়ে দেন। বাড়িতে নেকবরকে পাওয়া গেল। বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, নেকবর বাড়িতে গবেষণার কাজে লাগা সুইচ অ্যালবিনো প্রজাতির সাদা ইঁদুর, খরগোশ, মুরগি ও কবুতর পালেন। একটি ঘরের মধ্যে এগুলোর খাঁচা পাশাপাশি রাখা। এর মধ্যেই এক কোণে রাখা ছিল কাকটি। কাকটির গলার স্বর অন্য কাকের মতো নয়। অনেকটা হাঁস-মুরগির মতো করে ডাকে।

নেকবর প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা কাকটিকে হাঁস-মুরগির ফিড, রুটি খাওয়ান। সিরিঞ্জ দিয়ে পানি মুখে তুলে দেন। কাকছানা পাওয়ার গল্প এখন বেলঘরিয়া এলাকাজুড়ে। অনেকেই দেখতে আসেন।

কাকছানা কুড়িয়ে আনার গল্প নেকবরের বাড়িতে বসেই শোনা হলো। নেকবর বলেন, সাত–আট মাস আগে দুপুরবেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি হলো। সেদিন ঝড়ও ছিল। বাজার থেকে বাড়িতে এলেন। কিছুক্ষণ পর আবার গেলেন। বাজারের পাশে দেখলেন একটি কাকের ছানা পড়ে আছে। ছানাটির মাকে পেলেন না। ছানাটি রেখে এলে মরে যেতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে বাড়িতে নিয়ে এলেন। তখন বোঝার উপায় নেই, এটা আসলে কাকের ছানা। বাড়িতে আসার পর স্ত্রী বললেন, কিসের বাচ্চা এটা। তিনি কৌশলে স্ত্রীকে ডাহুক পাখির ছানার কথা বললেন, যাতে পাখির ছানাটা বাড়িতে রাখতে পারেন।

নেকবর বলেন, খিদে পেলেই কাকের ছানাটি আওয়াজ করত। তিনি গিয়ে খাইয়ে দিতেন। মাস দেড়েকের মধ্যেই ওড়াউড়ি শিখে যায়। বাড়ির পাশে আধা কিলোমিটার দূরে ঘাস কাটতে যাওয়ার সময় নেকবর নিয়ে যান, আবার নিয়ে আসেন। এ ছাড়া বাড়ির আশপাশ দিয়েই উড়ে বেড়ায়। তবে অন্য কোনো কাক এলেই বাড়ির ভেতরে চলে আসে।

আশপাশের মানুষজন শুরুতে নানা কথা বলতেন। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানেরাও খুব বেশি পছন্দ করত না। মাস চারেক আগে একবার দুপুরে ঘাস কাটতে গিয়ে কাকটিকে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে রেখে চলে আসেন নেকবর। পরের দিন বিকেলে গিয়ে দেখেন, বিলে কাকটি একটি গাছের ওপর বসে কিচিরমিচির করছে। তাঁকে দেখেই উড়ে এসে কাঁধে বসে আলতো করে ঠুকরে দেয়। তখন নেকবরের কান্না চলে আসে। কাকটিকে নিয়ে আবার চলে আসেন। এর পর থেকে কাকের সঙ্গে সখ্য তাঁর আরও বেশি বেড়ে যায়।

নেকবর বাজার থেকে বাড়িতে আসার সময় কিছু না কিছু কাকের জন্য নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো দিন অভ্যাস ছিল না ছেলেমেয়ের জন্য বাজার থেকে কিছু কিনে আনা। কিন্তু কাকটি এতই আপন করে নিয়েছে যে বাজারে একটি কলা খেলেও একটু করে সেই কলার অংশ নিয়ে আসি। বাজারে নিজের চুল কাটার দোকানেও মাঝেমধ্যে নিয়ে যেতে হয়।’

কাকটি দেখতে অনেকে আসেন। মো. শাহজাহান নামের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। নেকবর কুড়িয়ে পাওয়া কাকের ছানা এনে নতুন জীবন দিয়েছেন। তাঁর কাছে শেখার অনেক কিছু আছে।’

কাকটি সব সময়ই মুক্ত জানিয়ে নেকবর বলেন, ‘আমার বাড়ির আশপাশে বাঁশঝাড়। আমি চাই ও অন্য কাকদের সঙ্গে সে চলে যাক। ওকে লালন-পালন করতে আনিনি। এ কারণে কোনো নামও রাখা হয়নি। ও চাইলে যেকোনো সময় চলে যেতে পারে। ও চলে গেলে কষ্ট হবে। তবু চাই ও ওর প্রজাতির সঙ্গে থাকুক। সংসার করুক।’

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা পশুপাখি নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। মানুষ ও ওই পাখির মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয়। এমনই আস্থা তৈরি হয় যে ওই পাখি বা পশু বুঝতে পারে, ওই মানুষের দ্বারা তার কোনো ক্ষতি হবে না। এর বিপরীতে পশুপাখি যে ভালোবাসাটুকু দেয়, সেখানে কোনো স্বার্থের বিষয় থাকে না। নেকবরের বিষয়টিও হয়তো তা–ই হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণ পশুপাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়িয়ে দেবে।