কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তিস্তা নদীতে ভাঙন তীব্রতর হয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে এই দুই ইউনিয়নের ৫০টির বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরও এই দুই ইউনিয়নে নদীভাঙনে শতাধিক পরিবার তাদের ভিটেমাটি কিংবা একমাত্র ফসলি জমি হারিয়েছিল। তবে এসবের বিপরীতে শুষ্ক মৌসুমে ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ভাঙনের আগে শুষ্ক মৌসুমে পাউবোর লোকজনের দেখা পাওয়া যায় না। বন্যার সময় নদীতে ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিলেই কেবল পাউবোর লোকজন জিও ব্যাগ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন।
এই বক্তব্যের জবাবে পাউবো বলছে, এসব এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী কাজের বরাদ্দ থাকে না। সে জন্য কেবল বন্যার সময় ভাঙন শুরু হলে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানো হয়।
রাজাহাট উপজেলা অংশের তিস্তা নদীর দায়িত্বে থাকা কুড়িগ্রাম পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার সময় যখন যেখানে সমস্যা হয়, আমরা সেখানে চলে যাই। তিস্তায় আমাদের নিজস্ব একটা জরিপ চলমান আছে। সেটা হলে আমরা প্রকল্প পেশ করব। সেই বরাদ্দ না আসা পর্যন্ত তিস্তায় স্থায়ী কাজ হচ্ছে না।’
গতকাল শনিবার দুপুরে বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তিস্তাপাড়ের ভাঙনকবলিত কয়েকটি স্থানে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আহাজারি দেখা যায়। বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুরা গ্রামের কালীরহাট বাজার ও বাজারে অবস্থিত কালীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। মাত্র কয়েক মিটার দূরে তিস্তার চোখরাঙানি বলে দিচ্ছিল বিদ্যালয়টির সময় ফুরানোর বার্তা। বিদ্যালয় ও বাজারটিকে রক্ষার জন্য পাউবো এই দিনেই প্রথম জিও ব্যাগ প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। তবে এ উদ্যোগকে ‘লোকদেখানো’ বলছেন এলাকাবাসী।
চতুরা গ্রামের বাসিন্দা জাহেরুল ইসলামকে বাজারের পাশে ভেঙে যাওয়া একটি বসতভিটায় বসে তিস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। কয়েক দিন আগেও এখানে বসতি ছিল। সেই ভিটার অর্ধেক এখন তিস্তার ভাঙনে বিলীন। জাহেরুল বলেন, ‘এটা আমার বাড়ি ছিল। কয়েক দিন আগে তিস্তার ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। কিছু গাছ কাটার আগেই নদী খেয়ে নিয়েছে। এখন আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পাশের স্কুলে গিয়ে উঠেছি। ভাঙনের আগেই যদি সরকার ব্যবস্থা নিত, তাহলে আমাকে নিঃস্ব হতে হতো না। আজ কিছু জিও ব্যাগ এনে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো এই স্রোতে টিকবে না।’
পাশেই বাড়ি সরিয়ে নিতে সকাল থেকেই কাজ করছিলেন নমিতা রানী। অসুস্থ স্বামীকে পাশের বাসায় রেখে এসে একাই বাড়ির আসবাব গোছাচ্ছিলেন তিনি। কাজ করতে করতে বললেন, ‘গত শুক্রবারও নদী অনেক দূরে ছিল। এত দ্রুত ভাঙবে ভাবিনি। মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে। এই জায়গা ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই। এই অসুস্থ স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে এখন কোথায় থাকব? বাজারে জিও ব্যাগ দেখে এলাম। ওগুলো কিছুদিন আগে আনলেও বাড়িটা রক্ষা করা যেত।’
পাউবো শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় কাজ করতে আসে না জানিয়ে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর বন্যার সময় তিস্তায় প্রবল ভাঙন দেখা দিলে কেবল তাদের দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়। জনগণের টাকা এই প্রবল স্রোতে ফেলে অপচয় ছাড়া কোনো কাজেই লাগে না।
বাংলাদেশ অংশে তিস্তার প্রায় ৩২ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ এলাকা আছে বলে জানান রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও নদীগবেষক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, এগুলো স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি লাগে না। এতে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের প্রতি সরকারের মনোযোগ কম থাকার কারণে তিস্তার জন্য বিশেষ কোনো বাজেট থাকে না। এটি সরকারের হেঁয়ালিপনা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাউবো ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা দিয়ে যে ব্যবস্থা নেয়, সেটা তেমন কাজে আসে না।