দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে লটকন। সম্প্রতি নরসিংদীর রায়পুরার মরজাল হাটে
দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে লটকন। সম্প্রতি নরসিংদীর রায়পুরার মরজাল হাটে

একসময়ের ‘কদরহীন’ নরসিংদীর লটকনের বাজার এখন অন্তত ৩৫০ কোটি টাকার

একসময় ‘কদরহীন’ ফল লটকন পাওয়া যেত কেবল বনে-জঙ্গলে। ছিল না আর্থিক গুরুত্বও। এখন নরসিংদীর বেলাব ও শিবপুর উপজেলার যত্রতত্র দেখা যায় লটকনের বাগান। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে টক-মিষ্টি স্বাদের লটকন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে যা রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পাওয়া লটকনের বাজার এখন অন্তত ৩৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

লটকনের মৌসুমে এখন প্রতিদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত জেলার ওপর দিয়ে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে লটকনের হাট বসে। রায়পুরার মরজাল ও বারৈচা এবং শিবপুরের চৈতন্যার লটকনের হাট সবচেয়ে বেশি জমজমাট। এসব হাটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে অন্তত কয়েক কোটি টাকার লটকন। ট্রাকের পর ট্রাকে করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন পাইকাররা। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হচ্ছে লটকন। জেলায় এবার সবচেয়ে বেশি লটকনের আবাদ হয়েছে শিবপুর উপজেলার জয়নগর এলাকায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জেলায় ১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে লটকন আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল শিবপুরেই ১ হাজার ৬০০ হেক্টর। এ ছাড়া বেলাবতে ২০০ হেক্টর, রায়পুরায় ৫০ হেক্টর ও মনোহরদীতে ৪০ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৭ মেট্রিক টন হিসাবে এসব জমি থেকে মোট লটকন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য অন্তত ৩৫০ কোটি টাকা।

গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে টক-মিষ্টি স্বাদের লটকন। সম্প্রতি নরসিংদীর বেলাব উপজেলার জিরাহী গ্রামে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে জেলাজুড়ে লটকনের ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় চাষিরাও বেশ খুশি। লটকন বিক্রি করে চাষিরা এ বছর ২০০ কোটি টাকা লাভবান হবেন। জেলায় উৎপাদিত লটকনের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত বছর আগে শিবপুরের জয়নগর এলাকার বনে-জঙ্গলে লটকনগাছ দেখা যেত। সে সময় থেকেই স্থানীয়দের কাছে ফলটির কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। অযত্নে বেড়ে ওঠা লটকনগাছ একটি-দুটি করে শিবপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বেলাব উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বছর দশেক আগে থেকে সারা দেশে সুস্বাদু লটকনের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে শত শত বাগানে বাণিজ্যিক চাষের প্রবণতা শুরু হয়। এখন তো পাইকাররা আগেই কৃষকের বাগান এক মৌসুমের জন্য কিনে নেন। বর্তমানে এই দুই উপজেলায় প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে লটকন। এক মৌসুমে লটকন বিক্রির টাকায় সারা বছর সংসার চালান, এমন পরিবারের সংখ্যা এখন অনেক। সবাই লটকন নামে চিনলেও স্থানীয়ভাবে এর নাম বোগী বা গোডা।

সরেজমিনে বেলাব জিরাহী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে ঝুলে আছে থোকা থোকা পাকা লটকন। হলুদ হয়ে আছে একেকটা গাছ। অনেক গাছে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত এমনভাবে ফল ধরে যে ডালও দেখা যায় না। ঔষধি গুণসম্পন্ন লটকনের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষ দূরদূরান্ত থেকে ঘুরতে আসছেন। বাগানেই স্বাদ নিচ্ছেন পাকা লটকনের।

এ বছর প্রকার ও আকারভেদে প্রতি কেজি লটকন ৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে

জিরাহী এলাকার কাজল মিয়ার বাগানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঘুরতে এসেছিলেন একদল তরুণ। তাঁদের মধ্যে সুমন আহমেদ বললেন, গাছে ঝুলতে থাকা লটকন দেখার আনন্দই অন্য রকম। প্রচণ্ড লোভনীয় এবং চোখধাঁধানো সুন্দর। নিজের হাতে গাছ থেকে লটকন পেড়ে খাওয়ায় আনন্দ আরও বেশি। অনেকগুলো লটকন খেয়েছেন, বাগানের মালিক বলে দিয়েছেন যত পারেন খেতে, কিন্তু সঙ্গে করে নেওয়া যাবে না।

লটকনচাষি কাজল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রোপণের তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল আসে। একটি গাছে টানা ২৫-৩০ বছর ফলন হয়। গাছের তেমন রোগবালাই নেই। পরিচর্যাও করতে হয় কম। গাছে ফল কাঁচা থাকা অবস্থাতেই পাইকাররা বাগান কিনে নেন। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি লাভ হয় লটকনে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১৮ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করেছেন, আরও ৭-৮ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

মুখরোচক ফল লটকনের আছেন অনেক ঔষধি গুণও। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ এন এম মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লটকনে অধিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও আয়রন আছে। এসব উপাদান আর্থ্রাইটিস, পাকস্থলীর আলসারসহ বিভিন্ন ত্বকের সমস্যা সমাধানে কাজে দেয়। রুচি বাড়াতে এবং মানসিক অবসাদ দূর করতেও ফলটি উপকারী।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অন্তত ২০টি স্থানে লটকন বিক্রি করতে দেখা গেছে কৃষকদের। এর মধ্যে মরজাল, বারৈচা ও চৈতন্যা এলাকার হাটে স্থানীয় কৃষকেরা ভোর থেকেই ভ্যানে করে নিজেদের বাগানে আবাদ করা লটকন নিয়ে আসেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পাইকাররা দরদাম করে কিনে নেন এসব লটকন। এ বছর প্রকার ও আকারভেদে প্রতি কেজি লটকন ৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সড়কের পাশে বসেছে হাট। যাত্রীদের কাছে লটকন বিক্রির জন্য ঘুরছেন বিক্রেতারা। সম্প্রতি রায়পুরার মরজাল এলাকায়

হাটসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিক্রি হওয়ার পর বেতের ঝুড়িতে ১০ বা ২০ কেজি বা প্লাস্টিকের বস্তায় ৫০ কেজি লটকন ভরে পর্যাপ্ত পানি ছিটানো হয়। পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানোর জন্য ট্রাক বা ছোট-বড় পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। শুধু মরজাল হাটেই প্রতিদিন বিক্রি হয় তিন কোটি টাকার বেশি লটকন। আর সব হাট মিলিয়ে প্রতিদিন বিক্রি হয় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার লটকন।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, দেশ-বিদেশের বাজারে চাহিদা থাকায় এবং অল্প খরচে বেশি লাভজনক হওয়ায় বেশির ভাগ কৃষকই বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ করছেন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে নরসিংদীর ব্র্যান্ডখ্যাত লটকনের সুনাম। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরে ৩৫০ কোটি টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবেন নরসিংদীর কৃষকেরা।