তিন শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় গতকাল রোববার গভীর রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের কয়েকটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ সময় ৩০০৩ নম্বর কক্ষ থেকে দুটি ধারালো অস্ত্র (বগি দা) উদ্ধার করা হয়।
হলের একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা মহিউদ্দীন সিফাতের অনুসারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রুম্মন হোসেন ওই কক্ষে থাকেন। এটি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কক্ষ হিসেবে পরিচিত।
হলের ২০০৬ নম্বর কক্ষে তল্লাশি চালাতে গেলে সেটি বন্ধ পান প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকেরা। পরে বিকল্প চাবি দিয়ে কক্ষটি খুলে তল্লাশি চালানো হলে সেখানে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। ওই কক্ষটিতে তাহমিদ জামান ওরফে নাভিদ থাকেন। তাহমিদও মহিউদ্দীন সিফাতের অনুসারী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তাহমিদ জামান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে বেশ বেপরোয়া। এর জেরে প্রতিপক্ষ আলীম সালেহীর তিন অনুসারীকে গত শনিবার ওই কক্ষে আটকে মারধর ও কুপিয়ে জখম করেন তাহমিদ ও তাঁর অনুসারীরা।
ওই হলের অন্তত ছয়জন আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, হল প্রশাসন অভিযান চালাবে, এমন খবর পেয়ে ২০০৬ নম্বর কক্ষ থেকে সটকে পড়েন তাহমিদ। তাঁর কক্ষে থাকা ধারাল অস্ত্রও সরিয়ে ফেলা হয়।
দুটি দেশি অস্ত্র উদ্ধারের কথা নিশ্চিত করে হলটির প্রভোস্ট আবু জাফর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শনিবারের ঘটনার পর হলের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমরা কয়েকটি সন্দেহভাজন কক্ষে তল্লাশি চালাই। এ সময় ৩০০৩ নম্বর কক্ষ থেকে দুটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ওই কক্ষটিতে ছাত্রলীগের রুম্মন হোসেনসহ আরও সাতজন থাকেন। অস্ত্র উদ্ধারের পর কক্ষটি তালাবদ্ধ করে দিয়েছি। তবে ওই সময় রুম্মন কক্ষে ছিলেন না। এ ছাড়া ২০০৬ নম্বর কক্ষটি তালাবদ্ধ ছিল। পরে বিকল্প চাবি দিয়ে খুলে দুবার তল্লাশি করেও কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি।’
গত শনিবার গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে শেরে বাংলা হলের ২০০৬ নম্বর কক্ষে আটকে রেখে এবং পরে হলের সামনের মাঠে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে প্রভোস্ট আবু জাফর মিয়া খবর পেয়ে এসে রাত দুইটার দিকে তিনজনকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
নির্যাতনের শিকার তিন শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের রাজু মোল্লা, মো. মিলন হোসাইন ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সিফাত হাসান। তাঁরা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আলীম সালেহীর সমর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া তাহমিদ জামানের নেতৃত্বে এ নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
আহত রাজু মোল্লার ভাষ্য, গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তিনি ২০০৭ নম্বর কক্ষে পড়াশোনা করছিলেন। এ সময় তাহমিদ জামানের তিনজন অনুসারী তাঁকে কক্ষের বাইরে ডেকে নেন। এরপর তাঁরা জোর করে তাঁকে ২০০৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। ওই কক্ষে তাঁর দুই সহপাঠী সিফাত ও মিলন ছিলেন। এরপর তাহমিদ ও তাঁর অনুসারীরা তাঁর (রাজুর) কক্ষে কয়েকটি ধারালো অস্ত্র রাখার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাহমিদ ও তাঁর অনুসারীরা ক্ষিপ্ত হন।
রাজু মোল্লা বলেন, তাহমিদ ও তাঁর অনুসারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে চড়থাপ্পড় মারেন। পরে বেসবলের ব্যাট ও জিআই পাইপ দিয়ে মারধর শুরু করেন। এ সময় সিফাত ও মিলনকেও মারধর করা হয়। এভাবে রাত দুইটা পর্যন্ত তাঁদের ওপর নির্যাতন চলে। দুইটার পর সিফাত ও তাঁকে হলের সামনের মাঠে নিয়ে আবার মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর মাথায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়।
তবে অভিযোগের বিষয়ে তাহমিদ গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘রাজু মোল্লার কক্ষে ধারালো অস্ত্র পাওয়ায় হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁকে (রাজু) মারধর করেছেন। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
এর আগে গত ২৪ জানুয়ারি ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের একটি কক্ষে ঢুকে ছাত্রলীগের নেতা মহিউদ্দীন আহমেদ ওরফে সিফাতকে বেধড়ক মারধর ও কুপিয়ে জখম করে হেলমেট ও মুখোশ পরা দুর্বৃত্তরা। এ সময় ওই কক্ষে থাকা তাঁর দুই অনুসারীকেও মারধর করা হয়েছিল।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম আজ সোমবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের ঘটনার জেরে শনিবার রাতের ঘটনা ঘটেছে। বারবার ওই হলে এমন ঘটনা ঘটায় আমরাও বিব্রত। তবে প্রভোস্টকে বলা হয়েছে হলের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে। সে অনুযায়ী রোববার রাতে তল্লাশি চালানো হয়েছে।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এক যুগেও ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। তবে মহিউদ্দীন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আরেকটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন আলীম সালেহী ও অন্যরা। তাঁরা উভয়ই সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ গত বছর থেকে ক্যাম্পাসে নেই। ওই পক্ষের নেতৃত্বে আছেন অমিত হাসান ওরফে রক্তিম ও ময়িদুর রহমান ওরফে বাকি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, মহিউদ্দীন আহমেদের ওপর হামলার ঘটনায় আলীম সালেহী ও তাঁর সমর্থকদের নামে মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় আলীম সালেহীসহ তিনজন ঘটনার পর গ্রেপ্তার হলেও সম্প্রতি তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এদিকে হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে মহিউদ্দীন সিফাত ক্যাম্পাসের রাজনীতি থেকে বাইরে আছেন। তাঁর অবর্তমানে নেতৃত্বে আছেন তাঁর অনুসারী তাহমিদ জামান।