মনু নদের তীরে দেড় শতাধিক বছর আগে গড়ে ওঠা মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বালিকান্দি বাজার পশুর চামড়া বেচাকেনায় আলাদা পরিচিতি পেয়েছে। বছরজুড়েই বাজারটিতে চামড়া কেনাবেচা হলেও কোরবানির ঈদের দিনটি অন্য সব দিন-রাতের থেকে আলাদা, প্রাণচঞ্চল। কোরবানির ঈদের দিন শহর-গ্রামের অন্যান্য হাটবাজার যখন নিস্তব্ধ-নির্জন হয়ে পড়ে, দোকানপাট বন্ধ থাকে, বালিকান্দি বাজার ঠিক তার উল্টো। বাজারটি ঈদের এই একটা দিনে আরও সরগরম, আরও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এই একটা রাতে ঘুমায় না বাজারটি।
স্থানীয় লোকজন বলেন, এই বাজারের বড় ব্যবসায়ীরা ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনেন। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে পরবর্তী সময়ে ঢাকা, নাটোরসহ বিভিন্ন ট্যানারিমালিকের কাছে বিক্রি করেন। আগে ছোট ব্যবসায়ী অনেক থাকলেও কয়েক বছর ধরে চামড়া ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। এবার ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা দরে গরুর চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। ৩০০ টাকা কেবল তিন লাখ টাকার ওপরে যে গরুর দাম, সেগুলোর।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চাঁদনীঘাট মনু সেতুর কাছ থেকে পশ্চিম দিকে এগোতেই দেখা যায় সড়কে ছোট ছোট যানবাহন ও অনেক ধরনের মানুষের ব্যস্ততা। তাঁরা ঈদের ছুটিতে ঘুরতে থাকা মানুষ নন, তাঁরা ছুটছেন জীবিকার তাড়না থেকে। বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন, পরিবার-পরিজনের জন্য মাংস সংগ্রহের খোঁজে। বালিকান্দি বাজারে ঢোকার আগেই দেখা গেল একটি টিনশেডের খোলা ঘরে শতাধিক মানুষের কর্মব্যস্ততা। সড়কের পাশে স্তূপ করা শত শত কোরবানির পশুর চামড়া। ঘরের ভেতর, খোলা জায়গার বিভিন্ন স্থানে নানা বয়সের মানুষ চামড়া পরিষ্কারের কাজ করছেন। কারও দিকে কারও তাকানোর ফুরসত নেই। যে যত বেশি চামড়া পরিষ্কার করবেন, মৌসুমের এই একটা দিনে তত বেশি আয়।
ঈদের সময় প্রায় অর্ধশত মৌসুমি ব্যবসায়ী সক্রিয় হন, যাঁরা কয়েক শ চামড়া কিনে নিজেরাই প্রক্রিয়াজাত করেন। পরে বড় ব্যবসায়ী বা ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন।
বালিকান্দি গ্রামের মো. আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের দিন বিকেল চাইরটা থাকি বাজারে চামড়ার কাজ শুরু অয়। সারা রাইত চলব। কেউ কেউর পরদিন দুপুর, কেউর পরদিন রাইত পর্যন্ত চলব।’
রাত তখন আরও বেড়েছে। বালিকান্দি বাজারে তখন রমরমা অবস্থা। ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। এসব গাড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া নিয়ে আসছেন ফড়িয়ারা। সিলেটের বালাগঞ্জ থেকে আবদুস শহীদ নামের একজন ট্রাকে করে চামড়া নিয়ে এসেছেন। বিক্রি করতে আড়তে আড়তে ঘুরছেন। বাজারে বিভিন্ন রকমের কাজ। কেউ ট্রাক থেকে চামড়া নামাচ্ছেন। কেউ চামড়া পরিষ্কার করছেন। কেউ চামড়া থেকে মাংস আলাদা করছেন। চামড়ায় লবণ মাখার জন্য আছেন আলাদা দক্ষ শ্রমিক। এই একটা দিনে ঈদের আনন্দ নিয়ে তাঁরা কিছু ভাবেন না, তাঁদের লক্ষ্য এই দিনে বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন। বালিকান্দি বাজারে ঈদের রাতে এক হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন।
বালিকান্দি গ্রামের মাহমুদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঝখানে ব্যবসা ছাড়ি দিছলাম। এবার চাইর-পাঁচ শ চামড়া কিনার খেয়াল (কেনার লক্ষ্য) আছে। পরে কোম্পানি, নাইলে স্থানীয় বড় ব্যবসায়ীর কাছে বেচি লাইমু (বিক্রি করে দেব)।’ তিনি আরও বলেন, ‘লবণের দাম বেশি। লবণের ডরে কেউ মাল (চামড়া) কিনছে না। লবণে ব্যবসারে নষ্ট করিলার (করে ফেলছে)।’
ব্যবসায়ীরা জানান, এবার ৭৪ কেজি ওজনের লবণের একটি বস্তা তাঁরা ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে কিনেছেন।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজের ধরন অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা আছে। একটি চামড়া পরিষ্কার ২০ টাকা। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুরিও বাড়ে। তখন একটি চামড়া পরিষ্কার ৪০ টাকাও হয়ে থাকে। লবণশ্রমিকের কাজের মাত্রা অনুযায়ী মজুরি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবার কিছু শ্রমিক আছেন, যাঁরা মালিকের চামড়া প্রক্রিয়াজাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ করে পাবেন দেড় হাজার টাকা।
আবদুল মতিন, আবদুল কাসিমসহ তিনজন মিলে চামড়া পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। আবদুল মতিন বলেন, ‘বছরে একবারই এই কাজ (চামড়া পরিষ্কার) করি। একজনে ৫০টার মতো পরিষ্কার করতে পারে।’
এর মধ্যে কিছু লোক চামড়া পরিষ্কারের জন্য মালিকের কাছ থেকে টাকা নেন না। তাঁরা চামড়া থেকে মাংস বের করে সেই মাংস বিক্রি করেন। কেউ নিজেদের জন্যও সংগ্রহ করেন। দুজনকে এই মাংস সংগ্রহের কাজ করতে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে একজন রনি আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সাত থেকে আট বছর ধরি এই কাজ করি। ওটাই (মাংস সংগ্রহ) মনে করইন (করেন) আমরার রুজি।’ তিনি জানান, এভাবে চামড়া থেকে মাংস সংগ্রহ করে অনেকে দুই হাজার থেকে সাত-আট হাজার টাকা রুজি করতে পারেন। অনেক লোক আছেন, যাঁরা কোরবানি দেননি। অন্য কারও কাছ থেকে মাংস চাননি, পানওনি। জেলার বিভিন্ন উপজেলা, অন্য জেলা থেকেও এখানে এ রকম মাংস কিনতে অনেকে আসেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনগর থেকে আসা একজন ক্রেতা জানান, তিনি ৭০০ টাকা দিয়ে এক ব্যাগ মাংস কিনেছেন। ওজন হবে ছয় থেকে সাত কেজি।
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মনু নদের তীরসংলগ্ন বালিকান্দি বাজারটির বয়স দেড় শতাধিক বছর। ব্রিটিশ আমলে বাজার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এখানে চামড়া ব্যবসা চলছে। যদিও ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে থেকে বাজারটির আকার বড় হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ফড়িয়া ও ছোট ব্যবসায়ীরা সারা বছরই এখানে চামড়া নিয়ে আসেন। তবে কোরবানির ঈদেই চামড়ার বড় বাজার বসে। বাজারে পাঁচ থেকে ছয়জন স্থায়ী ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা সারা বছরই চামড়া কেনাবেচা করেন। ঈদে বড় অঙ্কের পুঁজি খাটান। এ ছাড়া ঈদের সময় আরও প্রায় অর্ধশত মৌসুমি ব্যবসায়ী সক্রিয় হন, যাঁরা কয়েক শ চামড়া কিনে নিজেরাই প্রক্রিয়াজাত করেন। পরে বড় ব্যবসায়ী বা ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। তবে ঢাকা ও নাটোরের অনেক আড়তদার এবং ট্যানারিমালিক নানা অজুহাতে এখানকার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা আটকে দেওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বাজারটি জৌলুশ হারাচ্ছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
বাজারের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ব্যবসায়ী মো. আইনুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, চায়ের স্টল সারা রাত খোলা থাকব। অনেকে কাজ না করলেও গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়। আমরাও একসময় দিয়েছি। ঈদের এই একটা রাত বাজার জেগে থাকে। এভাবে দেখেই আমরা বড় হয়েছি।’
বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শওকতের সঙ্গে তাঁর আড়তেই দেখা। ব্যবসার বাইরে কারও সঙ্গে তাঁর কথা বলার ফুরসত নেই। তিনি জানান, কাজের লোক থাকলে চার থেকে পাঁচ হাজার চামড়া কেনার লক্ষ্য আছে তাঁর। রাত যত বাড়ে, শান্ত হয়ে আসে গ্রাম। শান্ত হয়ে আসে চারপাশ। কিন্তু প্রাণ ফিরে আসে বালিকান্দি চামড়া বাজারে। এই একটা রাত বাজারটির জেগে থাকাতেই যত আনন্দ।