বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আসির ইনতিশারুল হক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আসির ইনতিশারুল হক

‘জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, আমার মনে দুঃখ নেই’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকেই অংশ নিতেন আসির ইনতিশারুল হক (২১)। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে গত ৫ আগস্ট রাস্তায় নামেন তিনি। এর মধ্যে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরও পান। আনন্দমিছিল নিয়ে ঢাকার পথে এগোনোর সময় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকায় বিজিবির সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান ইনতিশার।

ইনতিশারের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার উজান বৈলর গ্রামে। আ হা ম এনামুল হক ও নাজমুন নাহারের তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ইনতিশার। তিনি ময়মনসিংহ নগরের রুমডো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ত্রিশালের কাঁঠাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

গত শনিবার বিকেলে উজান বৈলর গ্রামে ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা এনামুল হক বলেন, ‘সেদিন আন্দোলনে যাবে আমরা জানতাম না। আগেও আন্দোলনে গেছে, সে সময় বাধা দিইনি। আমাদের মনে ভয়-আতঙ্ক ছিল, তবে আমাদের মৌন সম্মতি ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘তিন ছেলের মধ্যে বড় ইনতিশার। আমাদের পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত। আমাদেরও স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে সে প্রতিষ্ঠিত হবে। সামাজিক ও একজন ভালো মানুষ হবে, এই প্রত্যাশা ছিল। জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। আমার মনে দুঃখ নেই। সবাই তাঁদের শহীদ বলছে। আল্লাহ তাআলা যেন শহীদের মর্যাদা দেন, বাবা হিসেবে এটিই চাওয়া।’

আসির ইনতিশারুল হকের বাবা আ হা ম এনামুল হক

স্বজনেরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনে যোগ দিতে ত্রিশালের মামার বাসা থেকে বের হন ইনতিশার। বিকেল ৪টা ১১ মিনিট থেকে ৪টা ২৫ মিনিটের মধ্যে ইনতিশার গুলিবিদ্ধ হন বলে ধারণা পরিবারের। কারণ, ৪টা ১১ মিনিটের আগে নিজের ফেসবুকে সরব ছিলেন ইনতিশার। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মাওনার একটি হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে চিকিৎসকেরা ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ময়মনসিংহে নেওয়ার পথে সঙ্গে থাকা লোকজন ইনতিশারের নড়াচড়া না পেয়ে তাঁকে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত ইনতিশারুলের বাবা এনামুল হক বলেন, ‘ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে খবর পেয়ে যাই। সেখানে ছেলের লাশ পাই। একটি গুলি পেটের বাঁ পাশে লেগে ডান দিকে বেরিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে আমরা লাশ নিয়ে আসি।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তাঁর ফেসবুকে শেষ পোস্ট দিয়েছিল, লাল বৃত্তের মধ্যে স্বাধীনতা লেখা। কিন্তু আমার ছেলে সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি, স্বাদ ভোগ করতে পারেনি।’

স্বজনেরা জানিয়েছেন, ইনতিশারুলের বাবা এনামুল হক ফিশ ফিড (মাছের খাবার) ব্যবসায়ী। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তিনি যখন বাড়ি আসেন, তখন বৈলর বাজারে তাঁর দোকানে লুটপাট চলছিল। দোকানের কয়েক লাখ টাকার মালামাল লুট করে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

ইনতিশারের চাচা মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে আমাদের ভাতিজা জীবন দিয়েছে। ইনতিশারুলের বাবার দোকানটিও লুট করে নিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে যেন কাউকে পড়তে না হয়। আমরা বিচার চাই।’

ইনতিশারের বাবা এনামুল হকের মতে, যদি কোনো ঘটনার বিচার না হয়, তাহলে পরবর্তী সময় একই ধরনের অপরাধ ঘটার রাস্তা খুলে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সন্তান হত্যার বিচার নয়, সারা দেশে সব হত্যার বিচার চাই।’