সুন্দরবনের খালে জাল পেতে মাছ ধরছেন জেলেরা। সম্প্রতি সুন্দরবনের বস্টুমখালী খাল এলাকায়
সুন্দরবনের খালে জাল পেতে মাছ ধরছেন জেলেরা। সম্প্রতি সুন্দরবনের বস্টুমখালী খাল এলাকায়

সুন্দরবনে মাছ শিকারে ‘পানি পড়া’

গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩,৬৬০ কেজি মাছ জব্দ। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জেলে আটক।

‘সুন্দরবনের খালের পানিতে এখন আর পানি পড়া না দিলে মাছ পড়তে চায় না।’ এই পানি পড়ার মানে জানতে চাইলে এক জেলে বললেন, বনের মধ্যে খালের এক প্রান্তে জাল পেতে আরেক প্রান্তে পানি পড়া ছিটিয়ে দিলে মাছ সব দুর্বল হয়ে জালের মধ্যে চলে আসে।

অর্থাৎ বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টিকে তিনি পানি পড়ার সঙ্গে তুলনা করলেন। সম্প্রতি চার বনজীবী জেলের সঙ্গে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে এমন কথা জানতে পারেন এই প্রতিবেদক।

‘৫২ বছর ধরে জঙ্গল করি। কিন্তু আগে এসব বিষ দিয়ে মাছ ধরার চল ছিল না। পাঁচ বছরের মতো হলো বনে বিষ ঢুকেছে। এ জন্য আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। এখন ভাবতিছি ছাওয়ালগের কথা। আগের মতো সুন্দরবনে আর মাছও পাওয়া যায় না। আমার জীবন তো কাইটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবি?’
ময়জুদ্দিন মোড়ল, কয়রার উত্তর বেদকাশী পাথরখালী এলাকার জেলে

জলাশয়ে যদি এসব বিষ পড়ে, তাহলে সুন্দরবন আর থাকবে না। কিছুই বাঁচবে না—চার বনজীবী জেলের সঙ্গে গল্পের তালে তালে এগোতে থাকে নৌকা। নৌকায় বসে একটু খেয়াল করলে বনের ভেতরটাও দেখা যাচ্ছে। কেওড়া বনের নিচে ঝোপজঙ্গল কম থাকে। ভেতরে হরিণ ও বন্য শূকরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানরের পাল দৌড়ঝাঁপ করছে। নদীর চরে লম্বা লম্বা খুঁটি পোঁতা।

নৌকার বইঠা বাইতে বাইতে এক জেলে জানালেন, চরপাটা জাল পাতা হয়েছে ওখানে। ভাটা শেষ হওয়ার আগে খুঁটির সঙ্গে জাল বেঁধে কাদা মিশিয়ে রাখা হয়। ভরা জোয়ারে জাল পাতা হয়। ভাটায় যখন পানি নেমে যায়, তখন জাল থেকে মাছ ধরা হয়।

পাশেই নৌকায় রাখা জালের ওপর বসা আরেক জেলে বলে উঠলেন, ‘আমরা যারা সুন্দরবনে মাছ ধরি, তারা দিন-রাতের হিসাব করে চলি না। মাছ ধরা চলে “গোন” হিসাব করে। যাকে বলে ভরাকটাল ও মরাকটাল। “গোন” চলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার পর পর্যন্ত। গোনের সময় সপ্তাহখানেক বনের ভেতরে নৌকায় কাটে। বনে প্রবেশের আগে নৌকা ও জাল ঠিকঠাক করতে হয়।’

গল্পে গল্পে ঘণ্টা দেড়েক নৌকা চলার পর সুন্দরবনের বস্টুমখালী খালের পাড়ে নৌকা থামে। ততক্ষণে জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা লেগেছে। নৌকা থেকে লাফিয়ে খালের মধ্যে নেমে পড়েন এক জেলে। নৌকা বাঁধা হচ্ছে খালের মধ্যে। খালের এক প্রান্তে জেলেরা জাল পাতা শুরু করলেন।

অনেকটা তিন কোনাকৃতিতে পাতা হলো জালটি। জালের মুখের দিকটা বড়, পেছনের দিকে ছোট হতে হতে শেষ হয়েছে। প্রায় ৯০ হাত লম্বা জালের মুখ দিয়ে একবার মাছ ভেতরে ঢুকলে জালের শেষাংশে এসে আটকে থাকে। জালের শেষাংশে মাছ আটকে পড়া অংশকে জেলেরা বলে ‘ওচোল’। খালের দুই পাড়ে শক্ত লম্বা কাঠ পুঁতে জালের দুই মাথা বেঁধে দেওয়া হয়। জালের দুই পাশ পানি থেকে কিছুটা উঁচু রাখতেও কয়েকটি লম্বা কাঠ পোঁতা হয়। জালের ভেতর দিয়েই ভাটার টানে খালের পানি নামতে থাকে। পানির সঙ্গে নামতে থাকে মাছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জালের মুখে চলল চিংড়ির লাফালাফি।

এক জেলে জালের ওচোলে আটকে থাকা মাছ তুলে নিতে থাকেন ঝুড়িতে। খালের কিনারা দিয়ে কাদায় হাঁটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। দুই জেলে কিনারা ধরে চলে যান খালের আরেক প্রান্তে। সেখান থেকে খালের পানিতে নেমে ঢেউ দিয়ে মাছ তাড়িয়ে আনতে থাকেন জাল পেতে রাখা খালের প্রান্তে। ভাটায় পানি নেমে গেলে খালের ভেতর থেকে নৌকা বের করা যাবে না। তাই জালের মধ্যে আটকে পড়া মাছগুলো দ্রুত ধরে নিতে তাড়া দিতে থাকেন আরেকজন। জালে ধরা পড়েছে হরিণা, চাকাসহ নানা ধরনের চিংড়ি। সবাই মিলে চটজলদি মাছ খুঁটে নিয়ে জাল গুটিয়ে নৌকায় উঠলেন।

জেলে আনারুল ইসলাম বললেন, জোয়ার এলে কোথাও আটকে থাকা লাগে না। একটু হিসাব করে চলতে পারলে সময়মতো যেকোনো জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। হিসাব মেলাতে না পারলে কখনো কখনো ভাটায় নৌকা আটকে বিপদেও পড়তে হয়।

অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও বড় নদীতে এসে মাছের ঝুড়ি ধুয়ে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ আলাদা করতে করতে এই প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে এক জেলে বললেন, ‘আপনি না থাকলে মাছ আরও বেশি পাওয়া যেত। কারণ, একটু পড়া পানি ছিটিয়ে...।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই ধমক দিয়ে ওঠেন অন্য আরেক জেলে। বললেন, ‘যা হয়েছে শুকরিয়া আদায় কর। এই অল্প সময়ে সাত কেজির মতো চিংড়ি পাইছি। এটাই-বা কম কিসের?’

বন বিভাগ ও স্থানীয়রা কী বলেন

বন বিভাগ ও মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩ হাজার ৬৬০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়।

সুন্দরবনের পাতকোস্টা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় জানিয়েছেন, জেলেদের দাদনের ফাঁদে ফেলে কিছু অসাধু মানুষ বিষ দিয়ে মাছ শিকারে উৎসাহিত করে। আবার কেউ কেউ জেলেদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সংরক্ষিত বনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও পাচারে সুযোগ করে দেয়। বিষ দিয়ে মাছ ধরায় ৪০ জনের মতো জেলের সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়েছে।

সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাঁরা দ্রুত জামিনে এসে আবার একই কাজ করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ শনাক্ত করার মেশিন তাঁদের কাছে নেই। তাই প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা যায় না।

কয়রার উত্তর বেদকাশী পাথরখালী এলাকার জেলে ময়জুদ্দিন মোড়ল বলেন, ‘৫২ বছর ধরে জঙ্গল করি (সুন্দরবনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ)। কিন্তু আগে এসব বিষ দিয়ে মাছ ধরার চল ছিল না। পাঁচ বছরের মতো হলো বনে বিষ ঢুকেছে। এ জন্য আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। এখন ভাবতিছি ছাওয়ালগের কথা। আগের মতো সুন্দরবনে আর মাছও পাওয়া যায় না। আমার জীবন তো কাইটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবি?’