পদ্মা সেতু থেকে গত ১৯ জুন নদীতে পড়ে যান অটোরিকশাচালক শরিফুল ইসলাম। নদীতে পড়ার পর সারা রাত ভেসে থাকেন তিনি। ভোরের আলো ফোটার পর সাঁতরে তীরে ওঠেন। পরে সেখান থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে যান তিনি।
কয়েক মাস ধরে বাড়িতেই আছেন শরিফুল। পরিবার-প্রতিবেশী সবাইকে বলেছেন, তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে পদ্মা সেতুতে উঠেছিলেন। তারপর পদ্মা সেতু থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি তাঁর কথা।
সোমবার বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের উদয়পুর উত্তরকান্দি গ্রামে গিয়ে শরিফুলের পরিবার, প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে। শরিফুল ওই গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক জিন্নাত আলী গাজীর ছেলে। গ্রামে সবাই তাঁকে চেনেন জিন্নাত মাস্টার বলে। জিন্নাত বলেন, ছেলে ঢাকায় থাকত। সেখান থেকে অসুস্থ অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জে আসে। তাঁদের কাছ থেকে খবর পেয়ে তিনি গিয়ে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
জিন্নাত আলী আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রীও বেশ অসুস্থ, শরিফুলও কিছু করতে পারছে না। আমার পেনশনের টাকা দিয়ে দুজনের চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও ধারদেনা করে যতদূর পারছি, করছি।’
চিকিৎসা নেওয়ার বেশ কিছু ব্যবস্থাপত্র দেখান শরিফুল। এর মধ্যে গত ১৫ আগস্ট মোল্লাহাট উপজেলা হাসপাতালের একটি ছাড়পত্র আছে। সেখানে তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর (রেফার্ড) করার কথা আছে। গত ১৫ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শরিফুল। এর পর থেকে গোপালগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শরিফুলের শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের পারকুশলী গ্রামের উত্তরপাড়ায়। তাঁর শ্বশুর মোহাম্মদ দাউদ মোল্লা মুঠোফোনে বলেন, ‘সে আমাদের বলেছিল, পদ্মা সেতু দিয়ে নদীতে পড়ে গেছে। কিন্তু কেউই আমরা এ কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। অত উঁচু সেতু দিয়ে পদ্মা নদীতে পড়ে কেউ বেঁচে ফিরতে পারে? থানায় গিয়ে দেখলাম, রিকশাটি তাঁরই। এখন বিশ্বাস হচ্ছে।’
শরিফুলের প্রতিবেশী চয়ন মোল্লা বলেন, শরিফুলকে তাঁরা ছোটবেলা থেকেই চেনেন। শরিফুল ঢাকায় থাকেন, মাঝেমধ্যে বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। কিন্তু এই তিন মাস হবে বাড়িতেই আছেন। মধ্যে কিছুদিন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘শরিফুল আমাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় অনেকবার বলছে, সে পদ্মা সেতু দিয়ে পড়ে গেছে। রিকশা নিয়ে সেতুতে উঠেছিল। সেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। জামা উঠায়ে কাটার দাগ দেখাইছে। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি। এখন তো নিউজে দেখতেছি। এই সেই শরিফুল। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। এত উঁচু পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পড়ে কেউ বেঁচে যেতে পারে!’
শরিফুলের ভাই মো. মুরশিদ আলম গাজী বলেন, শরিফুল বেশ কয়েক মাস হলো বাড়িতে। তিনিও প্রথমে কিছু শোনেননি। পরে অসুস্থ হলে জানতে পারেন, ভাই নাকি পদ্মা সেতু থেকে পড়ে গিয়েছিল!
উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কামরুজ্জামান মোল্লা মুঠোফোনে বলেন, ‘এমন কিছু আমি শুনিনি। পদ্মা সেতু দিয়ে পড়া ওই রিকশাচালকের বাড়ি যে আমার এলাকায়, তা আমার জানা নেই।’
শরিফুল বলেন, তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস না করায় প্রথমে অসুস্থতার জন্য কেউ কোনো চিকিৎসা করাননি। তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন। কিছু করতে পারছিলেন না, খেতে পারছিলেন না। এভাবে বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর গত আগস্টে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তাঁকে হাসপাতালে নেন তাঁর বাবা। থানা থেকে রিকশা নিয়ে আসার পর সবাই এখন বিশ্বাস করছেন তাঁর কথা।