ফরিদ আর রনি আমের খুচরা বিক্রেতা। মুখোমুখি দুটি দোকানে বসেন। ফরিদ তামাশা করে রনিকে বলছেন, ‘আজ হিমসাগর কিনতে পারিসনি?’ রনি পেছনের একটি ডালি থেকে একটি হিমসাগর তুলে ধরে বললেন, ‘কিনেছি। লুকাইয়ে রাকিছি। তা ছাড়া যা দাম, চুরি হইয়া যাবি।’
রাজশাহীর আমের বড় মোকাম বানেশ্বর বাজারের দুই ব্যবসায়ীর এই রসালাপ শোনা গেল বুধবার দুপুরে। তাঁদের ভাষ্যমতে, লাফিয়ে বাড়ছে আমের দাম। এখন ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগর আমের ভরা মৌসুম। ঈদের আগে-পরে এই আমের দাম বেড়েছে মণে প্রায় এক হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার আমের উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেশি। তা ছাড়া ব্যাপারীদের জন্য আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো, অনলাইন ব্যবসায়ী। তাঁরা মণে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে ভালো আমগুলো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এই সুযোগে চাষিরাও বেশি দাম হাঁকছেন, ব্যবসায়ীদেরও সেই দামে কিনতে হচ্ছে। এই দুই কারণে আমের দাম বেড়ে গেছে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর কাচারি মাঠে আমের বাজার বসে। বাজারের একটি ছাউনির নিচে বসে বানেশ্বরের খুঁটিপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী মানিক ও আহসান হাবিব হিসাব মেলাচ্ছেন, কোন আম কী পরিমাণে বাজারে নামল। তাঁরা দুজনেই ছোটবেলা থেকেই আমের ব্যবসা করেন। তাঁদের কথোপকথন থেকে জানা গেল, এখন হিমসাগর প্রায় ৯০ শতাংশ শেষের পথে। তাই এই আমের দাম চূড়ায়। আজ বাজারে হিমসাগরের দাম হাঁকা হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা মণ। ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা।
ল্যাংড়া আম এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ বাজারে উঠেছে। তাই দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে আছে। আজ বাজারে ল্যাংড়ার দাম হাঁকা হয় ৪ হাজার টাকা মণ। ঈদের এক দিন আগে ছিল ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। আম্রপালি আম বাজারে এসেছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। ঈদের পর আম্রপালির দাম বেড়েছে মণে ৫০০ টাকার মতো। লখনা প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। কম মিষ্টির জন্য অনেকেই আমটিকে ডায়াবেটিক আম বলেন। ঈদের পর লখনার দামও মণে ৭০০ টাকা করে বেড়েছে। আগে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে।
বাজারে ঢুকে ব্যবসায়ীদের কথার সত্যতা পাওয়া গেল। বানেশ্বর বাজারের ব্যবসায়ী মহাতাব আলী বাগান কিনে ধীরে ধীরে আম বিক্রি করেন। তার দোকানে দুই ধরনের হিমসাগর পাওয়া গেল, একটি ডাঁশা ডাঁশা—দাম ৫ হাজার টাকা মণ। আরেকটি মাঝারি—দাম সাড়ে ৪ হাজার টাকা মণ। কোনোটির দাম এক টাকা কমাতে রাজি নন তিনি। দোকানে থাকা আম্রপালির দাম চাচ্ছেন ৩ হাজার ৪০০ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা মণ।
বড় আড়তদার জারমান আলী ঈদের আগের দিন প্রায় দুই হাজার মণ আম কিনেছিলেন। আজ দুপুরে আড়তে গিয়ে কোনো আম পাওয়া গেল না। তিনি ক্যাশ বাক্সের কাছে শুয়ে আছেন। জারমান আলী বললেন, ঈদের আগের দিন আম কিনেছেন। তারপর যেভাবে দাম বাড়ছে, তিনি এখন বাজার দেখছেন। দেখেশুনে কাল থেকে আম কেনা শুরু করবেন। তিনি বলেন, ঈদে সব আমের দাম বেড়েছে। এমনকি স্থানীয় গুটি আম মণে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা বেড়েছে।
ঈদের আগের দিন রাজশাহীর বাজারে কথা হয়েছিল নরসিংদীর ব্যবসায়ী জাহিদ হাসানের সঙ্গে। আজ মুঠোফোনে জানালেন, ঈদের কারণে তিনি চলে এসেছেন। সাত গাড়ি আম কিনেছেন। সেই আম বিক্রি করে পোষাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘রাজশাহীতে আমের যা দাম, তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে গাড়ি ভাড়া। ১৯ হাজার টাকার গাড়ি ভাড়া লাগল ২৩ হাজার। আরও খরচ আছে। সব মিলিয়ে রাজশাহী থেকে আম নিয়ে এসে আড়াই লাখ টাকার মতো লোকসান হয়েছে। এখন রাজশাহীতে দাম কমলে যাব, না কমলে অন্যদিকে বাজার খুঁজব।’
অনলাইনে আম ব্যবসায়ী পিএস অনলাইন মার্কেটের স্বত্বাধিকারী পরিনা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অভিজাত ক্রেতা, যাঁরা নির্ভেজাল আম খেতে চান, তাঁরা অনলাইনে ফরমাশ (অর্ডার) করেন। তাঁরা বাজারের সেরা আমগুলো বেশি দামে কিনে তাঁদের সরবরাহ করেন। তিনি বলেন, করোনার সময় থেকে অনলাইন বাজার বেড়েছে। এখন আরও চাঙা। তাই এর প্রভাব সরাসরি বাজারে পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, এবার লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ আম কম হতে পারে। তিনি বলেন, এবার রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। বড় আমগাছগুলোতে এবার আম কম আছে। কিন্তু ছোট গাছে পর্যাপ্ত আম আছে।
বানেশ্বর আমের হাটের ইজারাদার আল হাফিজ ইসলাম বললেন, এবার আমের দাম বেশি হলেও আম কম থাকায় ইজারার টাকা ওঠা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে আমের মৌসুম আরও এক মাস হয়তো থাকবে। দিন যত যাবে, আমের দামও তত বাড়বে।