আগে কোথায় বাড়ি ছিল, তা দেখাচ্ছেন মালতী রানী-রমেশ মণ্ডল। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বউবাজারে গত শুক্রবার
আগে কোথায় বাড়ি ছিল, তা দেখাচ্ছেন মালতী রানী-রমেশ মণ্ডল। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বউবাজারে গত শুক্রবার

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী

বুড়াগৌরাঙ্গের ভাঙনে নিঃস্ব তাঁরা

নদের ঘূর্ণিস্রোত এসে পড়ছে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের মাটি নদে ধসে পড়ছে।

১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় মালতী রানীর (৪৫)। স্বামী রমেশ মণ্ডলের (৫০) সংসারে এসে দেখেন, গোলা ভরা ধান, বাড়ির পুকুরে মাছ। সাজানো-গোছানো বড় বাড়ি। স্বামী রমেশ মণ্ডলের কৃষিজমির পাশাপাশি বাজারে বড় মাছের আড়ত ছিল। ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু বুড়াগৌরাঙ্গ নদের ব্যাপক ভাঙনে আজ তাঁরা নিঃস্ব।

মালতী রানীর বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ ইউনিয়নের হিন্দু গ্রামে। ওই গ্রামের পশ্চিম দিকে সাগরে বয়ে গেছে বুড়াগৌরাঙ্গ নদ। স্থানীয় লোকজন বলেন, আগে সারা বছরই ঘূর্ণিস্রোতে কমবেশি ভাঙন হতো। কিন্তু ১৫ বছর ধরে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। নদের ভাঙনে বিলীন হতে থাকে ইউনিয়নের হিন্দু গ্রাম, দক্ষিণ চর মোন্তাজ, বৌবাজার ও খেয়াঘাট। একসময়ের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো নদের ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে। অন্তত দুই শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমি, সরকারের আবাসন বা বাঁধের ঢালে। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমের আগ থেকে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। বর্তমানে ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে এই পরিবারগুলো।

২২ এপ্রিল সরেজমিন চর মোন্তাজ ইউনিয়নের হিন্দু গ্রামসংলগ্ন বুড়াগৌরাঙ্গ নদের পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদের ঘূর্ণিস্রোত এসে পড়ছে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের মাটি বড় বড় এলাকা নিয়ে ধসে পড়ছে। সেখানে রমেশ মণ্ডল ও মালতী রানীও অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তাঁদের দাবি, বুড়াগৌরাঙ্গ নদের ভাঙন থেকে বাঁচতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

মালতী রানী ও রমেশ মণ্ডল বলেন, এক কানি জমি নিয়ে তাঁদের বাড়ি ছিল। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, সঙ্গে পুকুরে ছিল মাছ। কিন্তু এখন তাঁদের ভিটেমাটি সবটুকু ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চারবার বাড়িঘর ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এখন সরকারের আবাসনে ঠাঁই হয়েছে তাঁদের। কিন্তু ভাঙন এখন সেদিকে এগিয়ে আসছে। বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙন প্রতিরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে আবাসনের আশ্রয়টুকুও তাঁদের হারাতে হবে। এই আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।

ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা মো. আলী (৫৮) জানান, বুড়াগৌরাঙ্গ নদের ভাঙনে তিনবার তাঁদের বাড়িঘর সরাতে হয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তি ছিল ৫ একর। কিন্তু সম্পত্তি বলতে এখন তাঁদের কিছুই নেই। বর্তমানে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বাস করছেন তিনি। বর্ষার আগে ভাঙন বেড়েছে। বাঁধের অনেকটা নদীতে ধসে পড়েছে। পুরো বাঁধ ভেঙে গেলে তাঁদের শেষ আশ্রয়ের ঘরও ভেঙে যাবে। এলাকার লবণপানিতে ফসলি খেত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নকুল মণ্ডলের (৫৫) বাপ-দাদার ১০ একর ৫১ শতাংশ জমির প্রায় সবটাই ভাঙনে পড়েছে। এখন তিনি বাঁধের ঢালে ঘর তুলে বাস করছেন। তিনি বলেন, নদের তীব্র স্রোত বাঁধের ওপর আছড়ে পড়ছে। বাঁধ ধসে পড়ছে নদে। তাঁরা ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কলাপাড়া কার্যালয় সূত্র জানায়, ৫৫/৪ পোল্ডারের পুরোনো বাঁধটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩২ কিলোমিটার। ১৯৮৭ সালে বাঁধটির নির্মাণকাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৯১ সালে। তবে বাঁধটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০০৭ সালের সিডরে। মেরামত করে বাঁধটি টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। 

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. মোশারফ মাতব্বর বলেন, সাগর মোহনায় বুড়াগৌরাঙ্গ নদের তীরের এই বাঁধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁদের ইউনিয়নের এই বাঁধ দক্ষিণ চর মোন্তাজ, বৌবাজার, হিন্দু গ্রাম ও খেয়াঘাট—এই চার এলাকায় লবণপানি থেকে ফসল রক্ষাসহ মানুষের জানমাল রক্ষা করে আসছে। কিন্তু প্রতিবছরই নদের তীব্র স্রোতে বাঁধ ভেঙে পড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতসহ বিকল্প টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে প্রতিবছরই বাঁধ নিয়ে ভাঙন এলাকার মানুষ আতঙ্কিত থাকবে।

কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, চর মোন্তাজ ইউনিয়নের বৌবাজার এলাকায় ৫৫/৪ পোল্ডারের বাঁধটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে ৪২০ মিটার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই ৪২০ মিটার বাঁধ জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।