পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে অবৈধভাবে অবস্থানরত ও পোষ্য কোটায় ভর্তি বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে বের করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও ছাত্রলীগের যেসব নেতা অবৈধভাবে হলের ‘রাজনৈতিক ব্লকগুলো’তে অবস্থান করছেন, তাঁরা বহাল তবিয়তে আছেন। তবে হল প্রাধ্যক্ষরা বলছেন, কিছু অছাত্রকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ দু–এক দিন সময় চেয়েছেন।
৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্যাম্পাসে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ছাত্রলীগের চার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত ও পোষ্য কোটায় ভর্তি শিক্ষার্থীদের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দেয়। গত রোববার পাঁচ দিন শেষ হলেও হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অন্যদের বের করতে পারেনি প্রশাসন।
হলের প্রাধ্যক্ষরা বলছেন, মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে ১২০ থেকে ১৫০ জন অছাত্র বের করা হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল থেকে ৬০ থেকে ৮০ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল থেকে ৩৫ থেকে ৪০ জন, শেখ রাসেল হলের ৩০ জন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের ১৩০-১৫০ জন, শহীদ সালাম-বরকত হল থেকে ৩০-৪০ জন, মওলানা ভাসানী হল থেকে ৩০ থেকে ৩৫ জনকে বের করা হয়েছে।
এদিকে হলগুলোতে কতজন সাবেক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই হল প্রশাসনের কাছে। তবে অবৈধদের হল থেকে বের করার নামে বৈধ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযাগ করেছেন কেউ কেউ। তাঁদের অভিযোগ, অনেক হলের ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ব্লকের কক্ষগুলোতে অভিযানই চালানো হয়নি।
মওলানা ভাসানী হলের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব বলেন, ‘এত দিন কোন শিক্ষার্থী কোন হলে অ্যালোটেড (বরাদ্দ করা হল), তা নিয়ে কোনো কড়াকড়ি নিয়ম ছিল না। যাঁর যাঁর ইচ্ছেমতো হলে উঠেছেন। একটি সংস্কৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এটা। এখন সবার দাবি অছাত্রদের বের করা। কিন্তু প্রশাসন অছাত্র বের না করে কারা অ্যালোটেড আর কারা অ্যালোটেড নয়, সেসব নিয়ে ঝামেলা করছে।’
বিভিন্ন হল ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হলের তিনতলায় ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ব্লক থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পড়াশোনা শেষ, এমন কাউকে হল থেকে বের করা হয়নি। তবে অবৈধভাবে অবস্থানরত কিছু শিক্ষার্থীকে বের করা হয়েছে। ছাত্রদের প্রায় সব হলের চিত্র একই। শহীদ সালাম-বরকত হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল এবং মওলানা ভাসানী হলের তিনতলায় রাজনৈতিক ব্লক থেকে কোনো শিক্ষার্থী নামেননি।
গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে লিটন মেয়াদোত্তীর্ণ এবং পোষ্য কোটায় ভর্তিকৃত ছাত্র। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৪৭ এবং ৩৪৯ নম্বর কক্ষ (প্রতিটি কক্ষ চার আসনের) দখল করে রেখেছেন। স্নাতকোত্তর শেষ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের (৪২ ব্যাচ) নিয়ন্ত্রণে আছে মওলানা ভাসানী হলের ৩২০ ও ৩২২ নম্বর কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ চার আসনের। ৪১তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান বঙ্গবন্ধু হলের ৩২২ নম্বর ও জুবায়ের আহমেদ মওলানা ভাসানী হলের ৩২৩ নম্বর কক্ষে থাকছেন। আরমান খান থাকেন মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে। তাঁদের মধ্যে মিজানুর রহমান শাখা ছাত্রলীগের আগের কমিটির সহসভাপতি। জুবায়ের মওলানা ভাসানী হল কমিটির সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। আরমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খানের ছোট ভাই।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গতকাল (রোববার) রাতে হল ছেড়ে দিয়েছি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কিছু কাজে প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে হলে আসতে হতে পারে।’ তবে হাবিবুর রহমানের অনুসারী দু–একজন জানান, সাধারণ সম্পাদক গত রোববার দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই ছিলেন।
গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, মওলানা ভাসানী হলে ছোট গণরুম রয়েছে সাতটি, চারজনের কক্ষে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী থাকছেন ১০-১২ জন, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে দুজনের কক্ষে থাকছেন ৫-৬ জন করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে চারজনের ৮টি কক্ষে থাকছেন ৮-১২ জন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ বলেন, ‘লিটন রোববার রাতে হল ছেড়েছে বলে জানিয়েছে। তার রুমে আমরা শিক্ষার্থী অ্যালোটমেন্ট (বরাদ্দ) দিয়ে তাদের উঠিয়ে দেব। বাকি যারা অবৈধ শিক্ষার্থী আছে, সবাইকে বের করার চেষ্টা চলছে।’
জানতে চাইলে শহীদ সালাম-বরকত হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘আমার হল থেকে ৩০–৪০ জন মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রকে বের করতে পেরেছি। হলে ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে। যাদের বের করা হয়েছে, সেই তালিকায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থী নেই।’
গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, মওলানা ভাসানী হলে ছোট গণরুম রয়েছে সাতটি, চারজনের কক্ষে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী থাকছেন ১০-১২ জন, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে দুজনের কক্ষে থাকছেন ৫-৬ জন করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে চারজনের ৮টি কক্ষে থাকছেন ৮-১২ জন করে। এসব হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা মেঝেতে তোশক বিছিয়ে থাকছেন। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে চার আসনবিশিষ্ট ৬টি কক্ষে ৮ থেকে ১০ জন থাকছেন এবং শহীদ রফিক-জব্বার হলে ৪ আসনের ১২টি কক্ষে ৬ থেকে ৯ জন থাকছেন।
হলগুলো থেকে অধিকাংশ অছাত্র শিক্ষার্থী বের হয়েছে উল্লেখ করে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলমত–নির্বিশেষে অছাত্রদের বের করা হচ্ছে। কয়েকটি হল থেকে অছাত্রদের বের করার এবং কারা অছাত্র রয়েছেন, তাঁদের তালিকা দিয়েছে। বাকি হলের তালিকা আগামীকালের (মঙ্গলবার) মধ্যে পেয়ে যাব।’
নিগার সুলতানা আরও বলেন, কিছু শিক্ষার্থী এখনো রয়ে গেছেন। তাঁরা বাসা খোঁজার জন্য দু-এক দিন নিজ নিজ প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে সময় নিয়েছেন। সবাইকে বের হতেই হবে।