বেইলি রোডের আগুনে বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না গ্রামের নাঈম হাওলাদারও মারা গেছেন। মুঠোফোনে ভিডিওকলে নাঈমের কবর দেখাচ্ছেন এক স্বজন। শনিবার সকালে
বেইলি রোডের আগুনে বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না গ্রামের নাঈম হাওলাদারও মারা গেছেন। মুঠোফোনে ভিডিওকলে নাঈমের কবর দেখাচ্ছেন এক স্বজন। শনিবার সকালে

‘আব্বু আমার খুব বিপদ, আমার জন্য দোয়া কইরো’

ছেলেটার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবে। ডিগ্রিতে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে এক মাস আগে ঢাকায় যায়। মার্চে তার ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। গত মঙ্গলবার ঢাকার বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ নেয়। তিন দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ওই ভবনে আগুন লেগে ছেলে মারা যায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না গ্রামের নান্টু হাওলাদার। বেইলি রোডের আগুনে বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর ছেলে নাঈম হাওলাদারসহ ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। নাঈম ওই ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নিয়েছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় সর্বশেষ ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন নান্টু হাওলাদার।

নান্টু হাওলাদার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফোন দিয়ে সে কান্দন লইছে। সে বলে, “আব্বু আমার খুব বিপদ, আমার জন্য দোয়া কইরো। আমার মার্কেটে আগুন লাগছে। আমি ছাদের ওপর আছি। আমার জন্য দোয়া কইরো।” আমি বললাম, লাইন কাটিস না। আমার কথা শোন, ছাদে উঠছো ছাদে থাক। আল্লায় একটা ব্যবস্থা করবেই। ছাদে তো আরও মানুষ আছে। সে বলে, “আমার ফোনে টাকা নাই।” আমি বলি, টাকা না থাকলে তুই ফোন কাইট্যা দে। আমি ফোন ব্যাক করতেছি। আমার সাথে কথা বললে তোর মনে সাহস বাড়বে। কিন্তু ফোনটা কেটে দেওয়ার পর আমি ফোন দিলে আর রিসিভ হয় না। শুধু রিং বাজে।’

একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন নান্টু হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘পরে টিভিতে খবরে দেখলাম ফায়ার সার্ভিস আইস্যা আগুন নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ছাদ থেকে লোকজন নামাইতেছে। তখন আশা নিয়া বসেছিলাম, আমার ছেলেও তো ছাদে আছে। ছাদের সব লোক নামাইছে কিন্তু আমার ছেলেকে তো কোথাও দেখি না। আধা ঘণ্টা পরে দেখি হঠাৎ কইরা দু-তিনজন আমার ছেলেকে ধরে ট্রলিতে শোয়াইয়্যা নিতেছে। তখন আমি চিৎকার মারছি, ওই আমার আব্বুকে নিয়া যায়। আমার আব্বু আর পৃথিবীতে নাই।’

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা মা লাকি বেগম। ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি

নাঈমের বাবা ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন আর মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ও নিজের পড়াশোনার খরচ জোটাতে নাঈম কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়েছিলেন। ছেলেকে হারিয়ে মা-বাবার আহাজারি থামছে না। নাঈমের বাবা শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। অভাবের সংসারে সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

নান্টু হাওলাদার বলেন, ‘আগুন আমার ছেলেটার স্বপ্ন পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাও হারিয়ে গেছে। আমি অসুস্থ। আমাদের দেখাশোনার মতো আর কেউ থাকল না। আশা ছিল, ছেলেটা বড় হয়ে আমাদের দুর্দশা দূর করবে। সেই ছেলেটাই পৃথিবী থেকে চলে গেল। দেনায় জর্জরিত আমরা। ছেলের জন্য যে দোয়া অনুষ্ঠান করব, সে জন্যও অন্যের কাছে হাত পাততে হবে।’

ছেলেকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেছেন নাঈমের মা লাকি বেগম। তিনি ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেছেন বৃহস্পতিবার বিকেলে। লাকি বেগম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে ছেলেকে কল দিয়া বলি, এ গেদু তুই তো কাইলও একটু কল দিলি না। ও বলে, “মা একটু ব্যস্ত ছিলাম। একটা মার্কেটে কাজ নিছি। তুমি টেনশন করবা না। আমি সাবধানেই আছি। রাইতে ভিডিও কলে কথা বলমু আনে, বলে ফোন কাইট্যা দেছে।” এই পর্যন্ত আমার সোনা বাবার সাথে আমার কথা হয়। এই শেষ কথা ওর সাথে। আমার আব্বায় আর কথা কয় নাই।’

লাকি বেগম বলেন, ‘এই রকম হইবে বুঝলে আমি কইতাম, তুমি ওইখান দিয়া এখনই যাও। আমি যা কইতাম হেইআই আমার ময়নাডা শোনতে। হের আগে যেহানে ছিলা অনেক শান্তিতে ছিলা। ডেইলি দুইফির তিনফির ফোন দিয়া কথা কইছে। কইছে, “মা আমি শান্তিতে আছি। তুমি টেনশন করবা না। তোমার আর কষ্ট করা লাগবে না। আমি আইছি কামাই (কাজ) করতে। তোমাগো আর কষ্ট লাগবে না। যত মানে (লোকে) টাহা পয়সা পায়, সব আমি শোধ করমু।”’ তিনি বলেন, ‘এখন কেডা দেখবে আমাগো। আর জিগাইন্যা মানুও নাই।’