বরিশালের মুলাদি উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে গত ২২ বছরে ২৮ জন খুন এবং অসংখ্য মারামারির ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে বিবদমান এ দুই পক্ষ শান্তি চুক্তি করায় এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।
গত শনিবার বিকেলে এ উপলক্ষে স্থানীয় বাটামারা জাগরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বরিশাল জেলা পুলিশের উদ্যোগে সম্প্রীতি সমাবেশ আয়োজন করা হয়। এতে বরিশালের পুলিশ সুপারের পাশাপাশি মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে দেড় হাজারের বেশি মানুষ যোগ দেন। সমাবেশে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, এলাকার শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে উভয় পক্ষ এক হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করে।
বাটামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মজিবুর রহমান সরদার বলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় বাটামারা ও সফিপুরের কবিরাজ, আকন, হাওলাদার ও হাজি গ্রুপ নামে চারটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বিরোধে লিপ্ত। তবে এ চার পক্ষ মিলে দুটি পক্ষ হয়ে যায়। এর মধ্যে কবিরাজ ও আকন গ্রুপ মিলে আকন গ্রুপ আর হাওলাদার ও হাজি গ্রুপ মিলে হাজি গ্রুপ নামে পরিচিত ছিল।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, মূলত ২০০১ সাল থেকে পক্ষ দুটি বিবাদে জড়ায়। জমি দখল, ইউপি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারসহ নানা অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বে গত ২২ বছরে উভয় পক্ষের ২৮ জন খুন হন। অসংখ্য মারামারির ঘটনায় অনেকে পঙ্গু হন। বাটামারা ইউনিয়নটি বরিশাল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর—এ তিন জেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় বড় ধরনের সংঘাত, খুনোখুনির পর পাশের জেলার আশ্রয় নিত। এ কারণে এসব ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ সহজে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারত না। তাই সন্নিহিত তিন জেলার পুলিশকেই ঘটনা সামাল দিতে বেগ পেতে হতো। আর এর সুযোগ নিত দুই পক্ষ।
বরিশাল জেলা পুলিশ জানায়, এসব ঘটনায় ৯৩৪টি মামলায় উভয় পক্ষের আসামির সংখ্যা ৪ হাজার ৪৩৯। সর্বশেষ চলতি বছরের ১০ এপ্রিল এ দুই পক্ষের বিরোধের জের ধরে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর উভয় পক্ষে উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও বোমা হামলার ঘটনা অব্যাহত ছিল। এতে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল।
সম্প্রতি এ বিরোধ নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেয় বরিশাল জেলা পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, শনিবার সম্প্রীতি সমাবেশে বাটামারা ইউনিয়ন ও মুলাদির গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় হাজি ও আকন নামে বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি সই হয়। হাজি গ্রুপের প্রধান তরিকুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম এবং আকন গ্রুপের প্রধান মোকছেদ আকন, মহিউদ্দীন, মনির হাওলাদারসহ উভয় পক্ষের ৩০ জন করে ৬০ জন ওই সমঝোতা চুক্তিতে সই করেন। একই সঙ্গে এলাকায় স্থায়ী একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য স্থানীয় জাহাঙ্গীর হোসেন, জাহাঙ্গীর হাওলাদার ও কাওসার উদ্দীন নামের তিন ব্যক্তি বিনা মূল্যে ২৫ শতাংশ জমি দান করেন। ১৯ জুলাই তাঁরা বরিশাল জেলা পুলিশকে ওই জমি রেজিস্ট্রি করে দেন।
বাটামারা ইউপির চেয়ারম্যান মো. সালাহ উদ্দিন গতকাল সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার মানুষের মধ্যে এই শান্তি চুক্তি স্বস্তি এনেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে স্থানীয়ভাবে এ নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করেছি। দেশের অন্য কোথাও এমন অমন অবস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না। সভ্য দুনিয়ায় এমন ঘটনার নজির নেই।’
বরিশালের পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এটা একটি কঠিন কাজ ছিল। এর সমাধান কী, সেই সূত্র বের করাও বেশ কঠিন ছিল। তবু আমরা আশাবাদী ছিলাম।’ পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই ওই এলাকার এমন খুনোখুনি, মারামারির ঘটনা শুনে আসছি। চাকরির সুবাদে বরিশালের দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য এ জন্য কাজ শুরু করি। ওই এলাকার মানুষের সহযোগিতায় সম্প্রীতি সমাবেশ হলো, সেখানে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প হলো। এটা করতে পেরে ভালো লাগছে।’