ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে যা বললেন স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বে থাকা জহুরুন্নেছা

তিন বছর ধরে ভৈরব স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সামলাচ্ছেন জহুরুন্নেছা। আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালে ট্রেন দুর্ঘটনার সময় নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বে ছিলেন জহুরুন্নেছা। তিনি ভৈরব স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কেবিন স্টেশনমাস্টার (গ্রেড-৪)। তিন বছর ধরে ভৈরব স্টেশনে দায়িত্ব পালনের সময় ছোট ছোট নানা দুর্ঘটনার পরিস্থিতি সামলেছেন তিনি। কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা এটাই তাঁর প্রথম। আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে জহুরুন্নেছা সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

জহুরুন্নেছা জানান, ঢাকাগামী আন্তনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনে ছেড়ে যাওয়ার জন্য বেলা ৩টা ২৫ মিনিটে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দৌলতকান্দি স্টেশন নিয়ন্ত্রণকক্ষের অনুমতির জন্য বার্তা পাঠানো হয়। এক মিনিট পর ঠিক ‘লাইন ক্লিয়ারের’ ফিরতি বার্তা আসে। এরপর এগারসিন্দুর ট্রেনটি ভৈরব স্টেশন ছেড়ে যেতে সবুজ বাতি জ্বালানো হয়। ট্রেনটি তখন স্টেশনের ৩ নম্বর লাইনে অবস্থান করছিল। ঠিক বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ৩ নম্বর লাইন থেকে ১ নম্বর লাইন অতিক্রম করছিল এগারসিন্দুর। সেই সময় বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনটি ‘হোম সিগন্যালে’ প্রবেশের কোনো অনুমতি ছিল না। কিন্তু চালক সিগন্যাল অমান্য করে ২ নম্বর লাইন থেকে ১ নম্বর লাইনে ক্রস করেন। তাতেই এগারসিন্দুর ট্রেনের পেছনের দুটি বগির সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।

দুর্ঘটনাস্থলে স্থানীয় মানুষজনের ভিড়। আজ মঙ্গলবার সকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে

এক মিনিট সময় পাওয়া গেলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত উল্লেখ করে জহুরুন্নেছা বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে বিষয়টি আমি স্পষ্ট মনিটরে দেখছিলাম। দুর্ঘটনার ৩০ সেকেন্ড আগে বিপদ বুঝতে পারি। তখন আমার শুধু একটি কথা মনে হয়েছে, বিপদের কারণ আমি কি না। শেষে মনিটর দেখে নিশ্চিত হলাম, এখানে ভৈরব কন্ট্রোলের কোনো দোষ নেই।’

স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ ও বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে জহুরুন্নেছা বলেন, প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের আগে চালককে দুটি সিগন্যাল অতিক্রম করে আসতে হয়। অনুমতি না থাকলেও চালক আউটার সিগন্যাল পয়েন্টে প্রবেশ করতে পারেন। তবে সেখানে ট্রেনটি থামিয়ে রাখতে হবে। হোম সিগন্যালে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই সবুজসংকেত দেখেই প্রবেশ করতে হবে। বর্তমানে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ হয় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে। অর্থাৎ একটি ট্রেন আউটার সিগন্যাল অতিক্রম করার আগে অন্য একটি ট্রেনের সবুজসংকেত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেটি সম্ভব নয়। শুধু চালক সিগন্যাল অমান্য করলে বিপত্তি দেখা দেয়। গতকালের ঘটনা সেই কারণেই হয়েছে বলে দাবি তাঁর।

দুর্ঘটনার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে জহুরুন্নেছা বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তাদের ফোন করে সমস্যাটি জানান। নিজের মনোবল ধরে রেখে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফোন করে সহযোগিতা চান। তাঁর ফোন পেয়ে ধীরে ধীরে ফায়ার সার্ভিস, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘বড় দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, সেটি ধারণা করতে পারছিলাম। মালবাহী ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেওয়ার কথা ছিল। সেই কারণে ট্রেনটির গতি আগে থেকেই কম ছিল। যদি ট্রেনটির ভৈরব স্টেশনে যাত্রাবিরতি না থাকত, তাহলে ট্রেনের গতি বেশি থাকত। তখন দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আরও বড় হতে পারত।’

মালবাহী ট্রেনের চালক সিগন্যাল অমান্য করে ২ নম্বর লাইন থেকে ১ নম্বর লাইনে ক্রস করায় দুর্ঘটনা ঘটে

আজ সকালে নিজ কার্যালয়ে কথা হয় ভৈরব স্টেশনমাস্টার মো. ইউসুফের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, তাঁদের কাজ হলো ট্রেনকে বৈধভাবে আনা ও বের করা। এগারসিন্দুর ট্রেনটি বৈধভাবে স্টেশন থেকে বের করা হচ্ছিল। ট্রেনটি বের হওয়ার পর মালবাহী ট্রেনটিকে ১ নম্বর লাইনে আসার অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু চালক অনুমতির অপেক্ষা না করে প্রবেশ করার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়।

গতকাল সোমবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকায় উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া আন্তনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের দুই বগির সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত শতাধিক। এই ঘটনায় মালবাহী ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও পরিচালককে (গার্ড) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা আজ ভৈরবে এসে মাঠপর্যায়ের তদন্তের কাজ করবেন বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।