আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। বিএনপি মাঠে নেই।
ঢাকা থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর শহরে প্রবেশের রাস্তার দুই পাশ পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এসব পোস্টারের অধিকাংশই নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের। শহরের অলিগলিতেও তাঁদের ব্যানার, বিলবোর্ড। এই নেতারা প্রতিদিন ছুটছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে, যোগ দিচ্ছেন একাধিক ইফতারে।
তবে শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। গাজীপুরে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ছাপ শুধু পোস্টার আর ইফতারে।
আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ৯ মে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচার। তবে শুভেচ্ছা, শুভকামনা, দোয়া চেয়ে করা পোস্টার এখন শহরের রাস্তায় রাস্তায়। বিভিন্ন অলিগলিতেও চোখে পড়ছে ব্যানার, বিলবোর্ড। ১৩ এপ্রিলের মধ্যে নিজ দায়িত্বে সব ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড সরাতে ইতিমধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম।
জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৩ জন। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৭ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র বাছাই ৩০ এপ্রিল, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৮ মে।
শহরের তিনটি ওয়ার্ডে গতকাল সোমবার নির্বাচন নিয়ে কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে। জয়দেবপুর রেলস্টেশনের পাশের এক চা–দোকানে পাওয়া গেল কয়েকজনকে। ভোটের তারিখ জানেন না কেউ। ৪৫ বছর বয়সী মোখলেছ মিয়া বলেন, ‘এখানে ভোট লাগে নাই অখনো। ঈদের পর লাগতে পারে।’
শহরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের চাপুলিয়া তিন রাস্তার মোড়ে কথা হয় ৬০ বছর বয়সী কেরামত আলী মোল্লার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘একসময় পাড়ার দোকানে চা–মুড়ি খেয়ে মানুষ ভোট করত। এখন নোট ছাড়া চলে না। ঈদের পর নির্বাচনের উত্তাপ শুরু হতে পারে।’
আনুষ্ঠানিক প্রচারে বাধা থাকলেও বসে নেই মেয়র প্রার্থীরা। শুধু পোস্টার, ব্যানার নয়, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ছুটছেন তাঁরা। দলীয় মনোনয়ন পেতে দিনের বেলায় ঢাকায় ছুটছেন আর বিকেল থেকে নিজস্ব অনুসারী নেতা-কর্মীদের নিয়ে নানা সামাজিক কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে। এ সবই করছেন মূলত আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের বাইরে বাকিদের খুব একটা কার্যক্রম চোখে পড়ল না। বিএনপি আছে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আর নিজেকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে পোস্টার করেছেন গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি এম এম নিয়াজ উদ্দিন। যাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা নিয়ে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। দলের পক্ষ থেকে বড় করে একটি ইফতার অনুষ্ঠানও করা হয়েছে।
গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে গাজীপুর মেয়র নির্বাচিত হন মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। ৩ বছর ২ মাস দায়িত্ব পালনের পর দল থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। একই সঙ্গে হারান মেয়রের পদ। তবে সাধারণ ক্ষমার আওতায় গত জানুয়ারিতে দলে ফিরেছেন। এখন ছুটছেন নৌকার মনোনয়ন পেতে। তাঁর অনুসারীরা প্রতিদিনই বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইফতার অনুষ্ঠান করছেন। ৪৭৫টি ভোটকেন্দ্রের জন্য ইতিমধ্যে ৪০ হাজার কর্মী দিয়ে ৪০০ কেন্দ্র কমিটি করা হয়েছে। বাকি ৭৫টির কাজ চলছে।
জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, চারটা, পাঁচটা, ছয়টায় তিনটি ইফতার অনুষ্ঠানে অন্তত ছয় হাজার মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। মসজিদ, মাদ্রাসা, তৈরি পোশোক খাতের শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সবার সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইছেন তিনি।
টঙ্গী পৌরসভার তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও মেয়র গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমতউল্লা খান। গাজীপুরের প্রথম সিটি নির্বাচনে ২০১৩ সালে দলীয় মনোনয়ন পান তিনি। ওই নির্বাচনে হেরে গেলে গত নির্বাচনে আর দলীয় মনোনয়ন পাননি। গতকাল তাঁর পক্ষে দলীয় মনোনয়ন ফরম নেওয়া হয়েছে। এবার নিয়মিত ঢাকায় ছুটছেন দলীয় মনোনয়ন পেতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন বাসায় রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ইফতারের দাওয়াত এলে সেখানে অংশ নিচ্ছেন।
জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকে সরানোর পর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান (কিরন)। এর আগের মেয়াদের প্রায় ২৭ মাস ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এবার তিনি নৌকার মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করছেন। প্রথম আলোকে আসাদুর রহমান বলেন, নির্বাচনী প্রচারে বাধা থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু করছেন না। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। ইফতারে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন।
আলোচিত তিন প্রার্থী ছাড়াও আরও অন্তত ছয়জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দলীয় ফরম নিয়েছেন। তাঁরাও ইফতারসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। এর মধ্যে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান তাঁর বাড়ির পাশে দিনে অন্তত ৩০০ মানুষকে ইফতার করাচ্ছেন।
গত সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার। বয়সের কারণে দলীয় কার্যক্রমে তিনি ততটা সক্রিয় নয়। এর আগে প্রথম সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে মেয়র হন বিএনপি নেতা এম এ মান্নান। তিনি মারা গেছেন। এবার নির্বাচনে বিএনপির কেউ মাঠে নেই।
গাজীপর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, সিটি নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপি স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেয়নি। বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য দলের মহাসচিব শিগগিরই নির্দেশনা দেবেন। তবে ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই।
শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নির্বাচনের তেমন আমেজ দেখা যায়নি। দুপুর ১২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েও তেমন কোনো কিছু চোখে পড়ল না। কার্যালয়টি পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছিল। শহরের চাপুলিয়া এলাকার এক চা–দোকানে বসে ৪০ বছর বয়সী আইয়ুব সরকার বলেন, আগে তফসিল হলেই ভোট নিয়ে আলোচনা শুরু হতো। এখন নির্বাচন মানেই ধোঁয়াশা। সবাই ধরে নেয়, সরকারি দলের প্রার্থী জিতবে। ইভিএম নিয়েও নানা বিভ্রান্তি আছে।
ভোট ঘিরে উৎসবের পরিবেশ তৈরি করতে হবে বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা আহ্বায়ক আমজাদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনো নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়নি। সব প্রার্থী মাঠে নামার পর নির্বাচনের প্রকৃত পরিবেশ বোঝা যাবে।