ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব সামলে নেওয়া সুন্দরবন এবার ডুবেছে আরও উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে। সুন্দরবনের গাছপালায় আচ্ছাদিত বিশাল প্রাচীরের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কম টের পেয়েছেন বঙ্গোপসাগর উপকূলের জনপদের মানুষ। রিমাল উপকূলে আঘাত হানার সময় জলোচ্ছ্বাসের পানির উঁচু চাপও ঠেকিয়েছে সুন্দরবন।
তবে গতকাল রোববার রাতে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার সময় এবং আজ সোমবার দুপুরে ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে গোটা সুন্দরবন। এতে নোনাপানিতে তলিয়ে গেছে বনের মাঝে থাকা মিষ্টিপানির পুকুরগুলো। অনেক বন্য প্রাণী ভেসে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের চেয়ে এবার পানির চাপটা বেশি ছিল। আসলে সিডর-আইলার চেয়েও এবার পানি অনেক বেশি হয়েছে। সুন্দরবনে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে এত পানি আগে কখনো দেখেননি। সাধারণ জোয়ারের চেয়ে অন্তত ৫ থেকে ৭ ফুট পানি বেশি হয়েছে করমজলে। কেন্দ্রের রাস্তাঘাট থেকে প্রায় সব জায়গায় কোমরসমান পানি হয়। সাগর উপকূলের দুবলা, কটকা, কচিখালী এলাকায় পানি আরও কয়েক ফুট বেশি হয়েছে। যেহেতু বনের সব জায়গা তলিয়ে গেছে, এতে বন্য প্রাণীর বেশ ক্ষতি হওয়ার কথা। তবে বন্য প্রাণীরা এর সঙ্গে অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়ে থাকে। তবে হরিণশাবক ভেসে যাওয়ার শঙ্কা বেশি।
জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে করমজল প্রজনন কেন্দ্রের কুমির-কচ্ছপসহ প্রাণীগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন হাওলাদার আজাদ। তিনি আরও বলেন, বনের মাঝে প্রাণীদের জন্য বেশ কিছু উঁচু স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এই টাইগার টিলাগুলোতে কিছু প্রাণী আশ্রয় নিতে পেরেছে। বনের গাছপালার কারণে এই ঝড়ের পুরো ধাক্কাটা পাননি লোকালয়ের বাসিন্দারা। এখানেই নদীর পাশে গেলে বাতাসের চাপের কারণে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তবে ভেতরে এলে গাছপালার মাঝে সেই চাপ অনেকটাই কম অনুভূত হয়। বনের কারণে ঝড়ের মূল গতি কমে যায়। ফলে লোকালয়ের ক্ষতি কমে যায়।
বন বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত বন্য প্রাণী ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বা এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে বনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সমুদ্র–তীরবর্তী দুবলার চর ও কটকা বন বিভাগের কার্যালয়ের জেটি স্রোতের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বন কর্মীদের থাকার ঘরের জানালার গ্লাস, মিষ্টিপানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সুপেয় পানির ট্যাংক, সোলার প্যানেল উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে বনের কটকা এলাকার পুকুরটি বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে ছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। তবে ঝড়ের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ভৌগোলিকভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার জনপদ ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুন্দরবনের অবস্থান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বরাবরের মতো এবারও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে উপকূল রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের উপকূলকে ঠিক মায়ের মতো বুকে আগলে রাখছে। ঝড়ের সময়ে সে নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও উপকূলের তেমন ক্ষতি হতে দেয় না।’