দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায় লিচুর বাজার। দুই দিনের বৃষ্টিতে বাজার ও আশপাশের রাস্তায় কাদাপানির মধ্যে ঠিকমতো হাঁটাই মুশকিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই চলছে বাহারি জাতের লিচু কেনাবেচা। এখানে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চায়না থ্রি জাতের লিচু। মৌসুমের শেষ সময়ে এসে আকার ও মানভেদে প্রতি ১০০ চায়না থ্রি জাতের লিচু ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতিটি লিচু বিক্রি পড়ছে ১২ থেকে ১৬ টাকা।
বৃহস্পতিবার সকালে কালিতলা লিচুর বাজার বিক্রেতাদের হাঁকডাকে বেশ সরগরম দেখা গেল। এক লিচু বিক্রেতাকে হাঁক দিয়ে বলতে শোনা গেল, ‘এই যে ভাই, বড় দানার চায়না থ্রি, খাঁটি দেশি বেদানা।’ আরেকজন বলছেন, ‘দেখে যান টসটসে লাল বোম্বাই। রসগোল্লার চাইতেও মিষ্টি। মিষ্টি না হলে টাকা দিবেন না। আসেন, আসেন, শেষ হইলে পস্তাবেন।’
দিনাজপুরের রসগোল্লাখ্যাত টসটসে লাল লিচু কিনতে দোকান থেকে দোকানে ঘুরছেন ক্রেতারা। দর-কষাকষি করে লিচু কিনছেন তাঁরা। ভ্যানে করে চাষিরা লিচু আনছেন আড়তঘরে। সেখানে চলছে নিলাম ডাক। দুই হাতে লিচুর থোকা নিয়ে নিলাম ডাকছেন একজন।
বিরল উপজেলার লিচুচাষি শিশির শাহ বলেন, এক হাজার গাছের বোম্বাই ও বেদানা লিচুগাছের বাগান আছে তাঁর। বিক্রি করেছেন ৩০ লাখ টাকায়। যিনি বাগান কিনেছেন, গত বছর তিনি লোকসান গুনেছেন। এবার লিচুর দাম ভালো। তাই গতবারের লোকসান এবার পুষিয়ে নিতে পারবেন।
লিচুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, ১০০টি বেদানা জাতের লিচু (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। হাড়িয়া বেদানা ৫০০-৫৫০ টাকা, কাঁঠালি জাতের লিচু ৫৫০-৬০০ টাকা, বোম্বাই লিচু আকারভেদে ৪০০-৪৫০ টাকা, চায়না থ্রি জাতের লিচু ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা ও চায়না-২ জাতের লিচু ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার শুরু থেকেই লিচুর দাম চড়া। মৌসুমের শেষ সময়ে এসে প্রতি এক হাজার লিচুতে জাতভেদে দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। বিশেষ করে চায়না থ্রি জাতের লিচুর দাম অনেক বেশি। এই লিচুর মাংস ও রস বেশি হওয়ায় এবং দেরিতে বাজারে আসায় চাহিদাও বেশি থাকে।
লিচু ব্যবসায়ী চুন্নু মিয়া বলেন, গতবার রোদে লিচু জ্বলে গিয়েছিল। এবার মাদ্রাজি ও বেদানা লিচুর ফলন কম ছিল। তবে দাম ভালো পাওয়ায় গতবারের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে গেছে। বড় বাগানগুলোতে অল্প পরিমাণ লিচু আছে, সেগুলো এখন বাজারে আসছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাগানিরা আর অপেক্ষা করবেন না। তাঁরা লিচু বাজারে তুলছেন। তিনি আরও বলেন, দিনাজপুরের লিচুর বাজার চলবে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত দিন। শেষ সময়ে ক্রেতা বেশি হওয়ায় ভালো দামও পাচ্ছেন লিচুচাষিরাও।
দিনাজপুরের বেলে-দোআঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য উপযোগী। এ অঞ্চলে চাষ হয় মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, চায়না থ্রি, কাঁঠালি জাতের লিচু। তবে বোম্বাই জাতের লিচু বেশি চাষ হয়। জেলার ১৩টি উপজেলায় কমবেশি সব স্থানে লিচু চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর, মহব্বতপুর, বিরলের মাধববাটি, করলা, রবিপুর, রাজারামপুর, মহেশপুর ও বটহাট এলাকায় এবং চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলায়।
মৌসুমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন গণপরিবহনে যায় দিনাজপুরের লিচু। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক ট্রাকে লিচু পাঠানো হয়। প্রতিটি ট্রাকে অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ লিচু ধরে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তরুণ উদ্যোক্তারা লিচু বিক্রি করে বেশ সাড়া ফেলেছেন। সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার মোসাদ্দেক হোসেন তাঁদের একজন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এবার সাড়ে চার লাখ টাকার লিচু অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছেন। এতে তাঁর প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে অনলাইনে ব্যবসা করার ইচ্ছা আছে তাঁর।
কালিতলা লিচুর বাজারে কথা হয় স্থানীয় শিক্ষক মামুন হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, অতিথি আপ্যায়নের জন্য লিচু কিনতে এসেছেন। চট্টগ্রামের এক হাজার ও কুমিল্লায় ৫০০ লিচু পাঠাবেন। বাজার থেকে চায়না থ্রি জাতের লিচু কিনেছেন প্রতিটি ১৩ টাকা দরে। ঝুড়িতে ভরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব লিচু পাঠাবেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার জেলায় ৫ হাজার ৪৮৯ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান হয়েছে। এর মধ্যে বোম্বাই জাতের লিচু ৩ হাজার ২৩৮ হেক্টর, মাদ্রাজি ১ হাজার, চায়না থ্রি ৭০৭, বেদানা ৩১০, চায়না-২ জাতের লিচু ১৩২ ও কাঁঠালি জাতের লিচু ২৪ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জাফর ইকবাল বলেন, লিচু দিনাজপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী ফল। এবার বোম্বাই ও চায়না থ্রি জাতের লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। মাঠ জরিপ অনুযায়ী ধারণা করছেন, এ মৌসুমে জেলায় প্রায় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়েছে। এতে চাষিরা গতবারের লোকসান এবার পুষিয়ে নিতে পেরেছেন।