জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণ করতে গিয়ে কাটা পড়েছে এক হাজারের বেশি গাছ। এবার আরও তিনটি ভবন নির্মাণের জন্য শুরু হয়েছে জলাশয় ভরাট। মহাপরিকল্পনা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের এসব কাজের শুরু থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আপত্তি জানিয়ে এলেও পাত্তা দিচ্ছে না প্রশাসন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কেটে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক ভবন নির্মাণের কাজ চলছেই। গত কয়েক বছরের বিভিন্ন সময় মহাপরিকল্পনা ছাড়া ভবন নির্মাণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আপত্তি জানালেও কার্যত কোনো সমাধান মিলছে না। অভিযোগ উঠেছে যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রশাসন নিজেদের ‘খেয়ালখুশিমতো’ যত্রতত্র জায়গা নির্বাচন করছে, গাছ কাটছে, ধ্বংস করছে জলাশয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও রয়েছে।
মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্লান) না করে যত্রতত্র গাছ কেটে ভবন নির্মাণ না করার দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষের দিকে উপাচার্য মো. নূরুল আলম একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ জন্য একটি টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি (টিএমসি) করা হয়েছিল। তবে সেটির বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই আরও কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণের আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা বলছেন, কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া হাজারো গাছ কেটে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের পর প্রশাসন এখন নজর দিয়েছে জলাশয় ও নিচু ভূমির দিকে। জলাশয় রক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সেসবের তোয়াক্কা না করে জলাশয় ভরাট করছে প্রশাসন।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও রয়েছে।
পরিকল্পিত উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ইতিমধ্যে অপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আরণ্যক জায়গাগুলোয় ১৭টি স্থাপনার কাজ করতে গিয়ে গাছপালা নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। এখন তারা জলাশয়ে ভবন বানাতে শুরু করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ১০ তলাবিশিষ্ট ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ শেষ। দ্বিতীয় ধাপে আরও ১২টি স্থাপনার কাজ চলছে। এসব ভবন করতে গিয়ে এক হাজারের বেশি গাছ কাটতে হয়েছে।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি নতুন করে তিনটি ভবনের কাজ শুরু হয়েছে। এতে কাটা পড়েছে তিন শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গাছপালাবেষ্টিত জায়গা বেছে নেওয়ার পাশাপাশি জলাশয়ের পাড় ও জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য পদার্থবিজ্ঞান ভবনের পাশের জলাশয় ইতিমধ্যে ভরাটের কাজ শেষ দিকে। অন্যদিকে গত মাস থেকে জীববিজ্ঞান অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের বিপরীতের জলাশয়ের বেশ কিছু অংশ ভরাট করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য আল-বেরুনী হলের সম্প্রসারিত ভবনসংলগ্ন জলাশয়ের একপাশে বেশ কিছু অংশ ভরাট শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরদিন বিষয়টি জানাজানি হলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ওই একই জলাশয়ের অন্য পাড়ে চারুকলা বিভাগের বহুতল ভবন (অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নয়) নির্মাণের জন্য শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। এই জলাশয়ে প্রতিবছর শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি আসে। জলাশয় ভরাট এবং ভলাশয়ের পাশেই বহুতল ভবন নির্মিত হলে পরিযায়ী পাখি আর আসবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।
দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সেটির আলোকে কাজ করছি। প্রশাসন যে জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে, সেখানেই ভবন করা হচ্ছে। এখন যে মাস্টারপ্ল্যান করার কথা বলা হচ্ছে সেটি পরবর্তী সময়ের জন্য।নাসির উদ্দীন, প্রকল্প পরিচালক
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, জলাশয়ের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে পাখিদের ফ্লাইট জোন নষ্ট হয়ে যাবে। আর ভবন নির্মাণের সময় কনস্ট্রাকশনের কাজ চলমান থাকলে উচ্চশব্দের মধ্যে জলাশয়ে পাখি আসার প্রশ্নই আসে না। শুধু পাখি নয়, অন্য অনেক বন্য প্রাণী রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে সেসব প্রাণীকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এ ধরনের কাজ আইন ও ন্যায়নীতির বাইরে গিয়ে বর্বরোচিত কাজ হিসেবেই গণ্য। কোনো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ক্যাম্পাস বন্ধের সময় এসব কাজ করা হচ্ছে।
২০১৯ সালে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে গাছ কেটে আবাসিক হল নির্মাণের চেষ্টা করা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জোরালো আন্দোলন করেন। ওই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন প্রশাসন। এরপর নির্মাণের কাজ থেমে যায়। তবে করোনাকালে বন্ধের সময় এসব ভবন নির্মাণের কাজ আবার শুরু করে প্রশাসন। এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ইদ ও পূজার ছুটিতে বন্ধ ক্যাম্পাসে গাছ কেটে ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। এমনকি ভোররাতে গোপনে গাছ কেটে বির্তকের মুখে পড়তে হয়েছে প্রশাসনকে। শেষ ১ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইদ ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়। তার পরদিনই বন্ধ ক্যাম্পাসে গাছ কেটে কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন ও চারুকলা বিভাগের ভবন নির্মাণ শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটা ও জলাশয় ভরাট করা যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, তা দৃশ্যমান। এরপরও গায়ের জোরে তড়িঘড়ি করে অংশীজনদের মতামতকে উপেক্ষা করে কাজগুলো করা হচ্ছে।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি
এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে পূজার ছুটি চলাকালে বন্ধ ক্যাম্পাসে গাণিতিক ভবনের পেছনে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি) ভবনের জন্য অন্তত ৭০টি গাছ কাটে প্রশাসন। একই বছর পূজার ছুটির তিন দিন পর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) ভবনের জন্য ভোররাতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র এলাকার জঙ্গলে অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলে কর্তৃপক্ষ।
যে জায়গায় কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তার ঠিক পাশে পাঁচতলাবিশিষ্ট নতুন প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। এই ভবন সম্পূর্ণ নয়। ভবনটির দুটি অংশের দক্ষিণ দিকের অংশ নির্মাণ করা হয়েছে। এই অপূর্ণাঙ্গ ভবনের তথ্য গোপন করে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৫২ কোটি টাকা বাজেটে আরেকটি প্রশাসনিক ভবনের কার্যাদেশ দিয়েছে প্রশাসন। তবে শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে সেটির কাজ শুরু করতে পারেনি প্রশাসন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, নতুন প্রশাসনিক ভবনের অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করতে ৪০ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কার্যালয় বলেছিল। এতে করে নতুন প্রশাসনিক ভবন পূর্ণাঙ্গ করলে এক শতকোটি বেঁচে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন নতুন প্রশাসনিক ভবনের পাশের জায়গায় কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। মূলত এর মধ্য দিয়ে নতুন প্রশাসনিক ভবন পূর্ণাঙ্গ না করে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করে কৌশলে আলাদা প্রশাসনিক ভবন করার সব বন্দোবস্ত শেষ করেছে। তবে প্রশাসনের এই কূটকৌশল আমরা বাস্তবায়ন করতে দেব না।’
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব ভবন নির্মাণের শুরু থেকেই মহাপরিকল্পনার দাবিতে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ, বিবৃতি দিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনসহ জাতীয় পর্যায়ের পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এমনকি আন্দোলনকারীরা সশরীর এসব কাজ বন্ধও করে দিয়েছেন কয়েক দফায়। তবে প্রশাসন এসব আন্দোলনের তোয়াক্কা করে না। শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে কাজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখে আবার শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে আংশিক পরিবর্তন এনে কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারিত হলে সেখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটা ও জলাশয় ভরাট করা যে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, তা দৃশ্যমান। এরপরও গায়ের জোরে তড়িঘড়ি করে অংশীজনদের মতামতকে উপেক্ষা করে কাজগুলো করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের মহাপরিকল্পনার মতো একটা যৌক্তিক দাবিকে কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করছে। এখানে চলমান গোটা নির্মাণকাজের প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ।
এসব বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সেটির আলোকে কাজ করছি। প্রশাসন যে জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে, সেখানেই ভবন করা হচ্ছে। এখন যে মাস্টারপ্ল্যান করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি পরবর্তী সময়ের জন্য।’
অসমাপ্ত প্রশাসনিক ভবনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি পুরোনো বিষয়। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
জলাশয়ের কিছু অংশ ভরাট করে কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে নাসির উদ্দীন বলেন, ‘বুধবার কলা অনুষদের ডিন, শিক্ষকসহ বিভিন্ন বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। সেখানে উত্থাপিত আপত্তি নিরসন করে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’ বন্ধের সময়কে বেছে নিয়ে গাছ কাটাল অভিযোগটি সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালে তিনি দেখলেও (সিন) কোনো জবাব দেননি।