সেচের পানির জন্য কৃষকের বিষপান, হাসপাতালে দেখতে গেলেন জেলা প্রশাসক

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ থেকে কৃষকেরা কার্ডের মাধ্যমে সেচের পানি পান
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে এক কৃষক বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। গত রোববার দুপুরে বিষপানের পর তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সোমবার রাতে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। তিনি এই কৃষকের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।

এই কৃষকের নাম মুকুল সরেন (৩৫)। গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবার নাম গোপাল সরেন। হাসপাতালে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ছিলেন ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কল্যাণ চৌধুরী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত সরকার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (গোপনীয় শাখা) মো. শামসুল ইসলাম।

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষক মুকুল সরেনকে তিনি তাঁর একটি ফোন নম্বর দিয়ে বলেছেন, তাঁর যেকোনো সমস্যার কথা তিনি যেন সরাসরি তাঁকে জানান। আর সুস্থ হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। কৃষকদের সমস্যার বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিষ পান করা তো কোনো সমাধান নয়, তাঁরা যেন কোনো সমস্যায় বিষপান না করেন, এ বিষয়ে তিনি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে বৈঠক করবেন।

গত বছরের ২৩ মার্চ গোদাগাড়ীর বর্ষাপাড়া গ্রামের পাশের নিমঘটু গ্রামের সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারানডি সেচের পানি না পেয়ে বিষ পান করেন। এতে অভিনাথ সেদিনই মারা যান। ২৫ মার্চ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রবি। এরপর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়। এবার সেই নলকূপের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাশেম আলী ওরফে বাবু নামে এক ব্যক্তিকে। তাঁর কাছেই পানির জন্য হয়রানির শিকার হয়ে মুকুল সরেন বিষ পান করেছেন বলে অভিযোগ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসাধীন মুকুল সরেন। ভর্তি খাতায় তাঁর নামের পাশে লেখা আছে ‘পুলিশ কেস।’ গতকাল বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার ঈশ্বরীপুর ব্লকে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন তিনি। এবার সর্বশেষ বৃষ্টি হওয়ার পরে অন্যদের জমিতে দুই-তিনবার করে পানি দেওয়া হয়েছে। তাঁর জমিতে পানি দেওয়া হয়নি। ছয়-সাত দিন ধরে অপারেটর হাশেম আলী তাঁকে ঘুরিয়েছেন। অপারেটর তাঁর নিজের জমিতে ছিটানোর জন্য তাঁকে একটি বিষের বোতল দিয়েছিলেন। মুকুল বলেন, তিনি অপারেটরকে বলেছিলেন, তাঁর জমিতে পানি না দিলে তিনি এই বিষই পান করবেন। তারপরও জমিতে পানি দেননি। নলকূপের একটা পাইপ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ওই পাইপের জন্য বিঘাপ্রতি ৮০ টাকা করে নেবে। সবকিছুতেই তাঁকে ঝামেলায় জড়ানো হচ্ছিল। তিনি টাকাটা এক দিন পরে আজ মঙ্গলবারে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অপারেটর বলেছেন, টাকা না পেলে পানি দেবেন না।

কৃষক মুকুল সরেন বলেন, ‘নাদিরপুরের একজন মেম্বার এসে দেখে বলেছেন, আমার কথা ঠিকই আছে। এই জমিতে আরজেন্ট পানি দেওয়া দরকার। তারপরও পানি না দিয়ে অপারেটর তাড়ি-গাঁজা খেতে চলে যান।’ তিনি বলেন, এরপর তিনি বিষ পান করেন। বিষপানের পর তাঁর সাড়ে তিন বিঘা জমিতে মাত্র ১৫ মিনিট পানি দেওয়া হয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। পরে কী হয়েছে তিনি বলতে পারবেন না।

হাসপাতালের মুকুলের শয্যার পাশে তাঁর মা দুলী হেমব্রম ছিলেন। তিনি বলেন, পানির জন্যই তাঁর ছেলে বিষপান করেছে। এর আগের দিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে পানির জন্য তাঁর বৃদ্ধ স্বামী অপারেটর হাশেম আলীর কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও পানি পাননি। এর পরদিন ছেলে মুকুল পানি নিতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল বলেন, এবার বোরো মৌসুমে কৃষক মুকুল দুই দিন তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি পানি পাচ্ছেন না বলে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন। একবার ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যকে এই কৃষকের জমি দেখতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি দেখে এসে বলেছেন যে জমিতে কয়েক দিন পরে পানি দিলেও চলবে।

মুকুলের বিষপানের বিষয়ে জানতে চাইলে গভীর নলকূপের অপারেটর হাশেম আলী ওরফে বাবু বলেন, এই নলকূপের অধীনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কৃষক আছেন। অনেক সময় তাঁরা দেশীয় মদ পান করে জমিতে সেচ দিতে আসেন। তাই কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেকোনো কৃষক মদ্যপ অবস্থায় গেলে তাঁকে পানি দেওয়া যাবে না। এ জন্য মদ পান করে আসার কারণে মুকুলকেও দুই দিন পানি দেওয়া হয়নি।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে কৃষকেরা কার্ডের মাধ্যমে সেচের পানি পান। এ বিষয়ে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বুঝি না, ওদের কী হয়। আসলে এটা পানির সমস্যা নয়। অন্য ব্যাপার আছে। বিএমডিএর কর্মকর্তাদের দেখতে পাঠিয়েছি। ওদের নিয়ে একটা মিটিং করব।’