প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে নৌ পুলিশের বসানো আটটি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার চারটিই নষ্ট হয়ে গেছে। সচল থাকা বাকি চারটির দুটি রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ির আঙিনায়। কার্যত হালদায় নজরদারির জন্য রয়েছে মাত্র দুটি ক্যামেরা। নদীর মা মাছ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সার্বক্ষণিক নজরদারির উদ্দেশ্যে তিন বছর আগে এসব ক্যামেরা বসানো হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বসানো সিসি ক্যামেরাগুলো দিয়ে নদীটির গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন এলাকা হাটহাজারীর মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার নজরদারি করে আসছিল নৌ পুলিশ।
নৌ পুলিশ জানায়, অবৈধভাবে মাছ শিকার, ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল ও বালু তোলা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছে নদীতে বসানো এসব ক্যামেরা। সিসি ক্যামেরায় মাছ শিকারসহ অবৈধ কোনো কার্যক্রম চোখে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে স্পিডবোট নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু বজ্রপাত ও যান্ত্রিক ত্রুটিতে প্রায় এক বছর ধরে চারটি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে পড়েছে। এতে নদীতে নজরদারি ব্যাহত হচ্ছে। এখন নদীতে প্রজনন মৌসুম চলছে। মার্চ থেকে জুলাই মাসের মধ্যে নদীতে একাধিকবার ডিম ছাড়ে মা মাছ। গবেষকেরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে হালদাকে বেশি সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন।
সম্প্রতি হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাস মুন্সিরহাট এলাকায় অবস্থিত নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ে বসে সিসি ক্যামেরায় নদীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন উপপরিদর্শক (এসআই) মাহফুজুল হাসান। তিনি বলেন, সচল ক্যামেরা দিয়ে নদীর মাত্র কয়েক কিলোমিটার এলাকায় নজরদারি করা যাচ্ছে। ক্যামেরা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি নৌ পুলিশের ঢাকা সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে।
নৌ পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, হালদায় বসানো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়াও নৌ পুলিশের ঢাকায় অবস্থিত উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকেও নদীতে নজরদারি রাখা হয়। এতে নদীতে জাল পেতে মা মাছ শিকারসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসে। ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় নদীতে থাকা বিপন্ন ডলফিনের মৃত্যুর হারও কমে আসে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, উন্নত মানের সিসি ক্যামেরাগুলো বসানোর জন্য ভালো মানের খুঁটি ব্যবহার করা হয়নি। কিছু ক্যামেরা বসানো হয় বাঁশের খুঁটিতে। এতে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে ক্যামেরাগুলো হেলে পড়ে নষ্ট হয়ে পড়ার ঝুঁকি শুরু থেকেই ছিল। নৌ পুলিশের বাইরে নদীর ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার এলাকায় বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের বসানো ৮টি তারহীন ক্যামেরা বসানো রয়েছে, সেগুলো সচল।
হালদা নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহ করেন স্থানীয় বাসিন্দা অমর বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। তাঁরা ডিম সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছেন। অমর বড়ুয়া আরও বলেন, ‘নদীতে পুলিশের নজরদারি থাকলে মা মাছ যেমন রক্ষা হয়, বিপদে-আপদে আমরাও সাহস পাই।’
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকার ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের হালদা নদীর রাউজানের কচুখাইন গ্রাম থেকে ফটিকছড়ি নাজিরহাট পর্যন্ত এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে নদী থেকে বালু তোলা এবং বালুবাহী ড্রেজার, যান্ত্রিক নৌ চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নদীতে জাল পাতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অংগ্যজাই মারমা এবং হাটহাজারীর ইউএনও এ বি এম মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হালদা নদী এখন শতভাগ যান্ত্রিক নৌযানমুক্ত। এর প্রভাবে গত এক বছরে হালদা নদীতে কোনো মা মাছ এবং ডলফিনের মৃত্যু হয়নি। আগে যান্ত্রিক নৌযানের পাখার আঘাতে বছরে ১০ থেকে ১২টি ডলফিন ও মা মাছের মৃত্যু হতো।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর (২০২৩) হালদা নদী থেকে কার্পজাতীয় মা মাছের প্রায় ২০ হাজার কেজি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে ৮ হাজার ৫০০ কেজি এবং ২০২০ সালে ২৫ হাজার কেজি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ হয়। ২০২০ সালে সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ ছিল এর আগের ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদা দিয়েই আমাদের দেশে নদীতে প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছিল সরকার। এটির সুফল অনেক দিক থেকে এসেছে। গত এক বছরে নদীতে কোনো ডলফিন ও মা মাছের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। প্রযুক্তিগত এই নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা উচিত।’