এভারেস্টজয়ী বাবর আলীর বাড়িতে যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাট থেকে ডান দিকে নেমে যাওয়া সড়কের মুখে দাঁড়িয়ে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবর আলীর বাড়ি কোন দিকে? একমুহূর্ত দেরি না করে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিটি বললেন, এ পথ ধরে কিছু দূর এগোলেই পুকুরপাড়। পাড়ের সঙ্গে লাগানো বাড়িটিই বাবরদের। আজ রোববার দুপুরে বাবরের বাড়িতে যাই। তখন তাঁদের বাড়িতে রীতিমতো উৎসব চলছিল। এক প্রতিবেশী বাবরের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরও নিশ্চিত হতে তাঁকেও একই প্রশ্ন করি। তাঁর উত্তর, বাবরের বাড়ি এখন কে না চেনে। বাবর এখন বিখ্যাত। এভারেস্ট জয় করেছে। এই যে সোজা দোতলা বাড়িটিই তাঁদের।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন চট্টগ্রামের সন্তান বাবর আলী। আজ নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটায় তিনি চূড়ায় পৌঁছান। বাবরের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীর দোয়ায় প্রকৃতিমাতা (এভারেস্ট) বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এখন বাবর আছে ক্যাম্প ৪-এ নামার পথে। ওই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই অভিযানের ছবি পেতে সময় লাগবে।’
এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করার খবর সকালেই পেয়েছেন বাবরের মা লুৎফুল নাহার বেগম ও বাবা মো. লিয়াকত আলী। এর পর থেকেই তাঁদের কাছে অনবরত ফোন আসছে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী অনেকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। দুপুর ১২টার দিকে বাবরদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিবেশীরা আসছেন। অভিনন্দন জানাচ্ছেন বাবরের মা–বাবাকে।
একফাঁকে বাবরের মা লুৎফুল নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস ধরে ঘুমাতে পারছি না। ছেলে এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিল, যেখানে মৃত্যুঝুঁকি আছে। দিনে মাত্র দুই–তিন ঘণ্টা করে ঘুমিয়েছি। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। নিরাপদে নেমে এলে এ দুশ্চিন্তা কমবে।’
দুশ্চিন্তা থাকলেও বাবরের মা-বাবা দারুণ আনন্দিত। ছেলের এমন প্রাপ্তিতে তাঁদের চোখ ছলছল করছিল। তাঁরা বলেন, ‘বাবর দীর্ঘদিন ধরে এভারেস্ট ও আরেক পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে আরোহণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। দুশ্চিন্তা করব, এ ভয়ে আমাদের বিস্তারিত জানাত না সে। প্রস্তুতি শেষ করে যখন জানিয়েছে, তখন থেকেই ভয়টা বাড়তে থাকে। কারণ, চূড়ায় উঠতে গিয়ে একটু এদিক-সেদিক হলেই মৃত্যু। তবে শেষ পর্যন্ত চূড়া ছুঁতে পারায় আমরা গর্বিত।’ বাবররা তিন ভাই-বোন। তাঁরা সবাই অত্যন্ত খুশি।
১৫ মে মা-বাবার সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল বাবরের। ক্যাম্প থেকে ফোন করেছিলেন তিনি। দেখিয়েছিলেন পর্বতমালার অনিঃশেষ সৌন্দর্য। স্মৃতিচারণা করে মা লুৎফুল নাহার বেগম বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে ফোন করার পর বাবরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। সে হিমালয়ের দৃশ্য দেখিয়েছিল। তাকে তখনো সাবধান করেছি।’
বাবরদের বাড়িটি দুইতলা। দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকেন বাবর। তাঁর কক্ষে যেতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগে চোখ আটকে গেলে দেয়ালে। বাবরের পর্বতারোহণের ছবি ও অর্ধশতাধিক পদক ঝুলছে দেয়ালজুড়ে। কলকাতা পুলিশ সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ হাফ ম্যারাথনের, কাপ্তাই হাফ ম্যারাথন, সাইক্লিং ম্যারাথন—কত বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ডই না করেছেন বাবর আলী। এসব কর্মসূচির পদকগুলো দেখা গেল সিঁড়ির দেয়ালে। দোতলায় বসার ঘরে বাবরের আরও কিছু পদক ও সম্মাননা রাখা ছিল। পাওয়া গেল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সাইকেলযাত্রার একটি নিদর্শন।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে সাইকেলযাত্রা শুরু করেছিলেন বাবর আলী। এক মাসের চেষ্টায় প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে গিয়ে থেমেছিলেন তিনি। পথে যেতে যেতে ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। এসব পথে ঘুরতে গিয়ে নানা বৈচিত্র্যময় শোপিসও সংগ্রহ করেছেন তিনি। তাঁর মধ্যে একটি কাঁসার থালা রাখা ছিল বাবরের ঘরে। অবশ্য ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেন বাবর।
পেশায় চিকিৎসক বাবর ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশ। এ বিষয়ে মা লুৎফুল নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বাবর ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল। তবে মেধাবী ছিলেন। তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। এভারেস্টে যাওয়ার আগেও মা–বাবার সঙ্গে এটা নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর। বাবর বলেছিলেন যে এ রকম দুঃসাহসিক ভ্রমণ তিনি করতে চান। এ জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত তিনি।
ট্রেকিং জগতে বাবর আলীর হাতেখড়ি হয় ২০১০ সালে। ওই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়ান তিনি। সফলতার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কীভাবে বিশ্বের বড় বড় পর্বতে উঠবেন, সেই পরিকল্পনা চলতে থাকে মস্তিষ্কে। এরপর গত এক দশকে হিমালয়ের নানা পর্বত জয় করেছেন পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী। এর মধ্যে ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম (২২ হাজার ৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন বাবর।
বাবরের ভিন্নধর্মী অভিযাত্রায় গর্বিত বাবা মো. লিয়াকত আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পেশায় চিকিৎসক হলেও সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এভারেস্টে ওঠার পর তার নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল। তাকে সবাই চেনে এখন। আগে বাদশা মিয়া সিপাহির বাড়ি বললে চিনত সবাই। এখন বাবর আলীর বাড়ি বললেও সবাই চেনে।
বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন গত ১ এপ্রিল। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেসক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল।
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এ জন্য একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করেছেন বাবর। ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে এভারেস্টের ক্যাম্প–২ পর্যন্ত ঘুরে এসে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব সমাপ্ত করেন। এরপর অনুকূল আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় বাবরকে।
১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে বাবরের যাত্রা শুরু হয় চূড়া অভিমুখে। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর উঠে যান ক্যাম্প ৩-এ। সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ‘ডেথ জোন’। ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মে ভোরের প্রথম আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা। শেষ ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্টজয়ী পঞ্চম বাংলাদেশি সজল খালেদ এভারেস্টের চূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান। এর ১১ বছর পর আরেক বাংলাদেশি পতাকা ওড়ালেন অপূর্ব এভারেস্টের চূড়ায়।
পর্বতারোহণে যাওয়ার আগে বাবর আলী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে যাওয়া অনেকের স্বপ্ন। প্রতিবছর হাজারো পর্বতারোহী এভারেস্টের পথে হাঁটেন। কিন্তু এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পর একই সঙ্গে আরেক পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে ওঠার চেষ্টা বাংলাদেশ থেকে আগে হয়নি। আমি সেই চ্যালেঞ্জই নিলাম। অর্থাৎ একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট ও চতুর্থ উচ্চতম পর্বত মাউন্ট লোৎসের চূড়ায় উঠব।’
এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। এখন বাকি লোৎসে। সেদিকেই তাকিয়ে এখন গোটা দেশ।