সুনামগঞ্জে রমজান মাসে মুনাফা ছাড়া নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য তরুণদের উদ্যোগে দেওয়া দোকানে কেনাকাটা করছেন লোকজন। গতকাল রোববার বিকেলে পৌর শহরের কেন্দ্রস্থল আলফাত স্কয়ার এলাকায়
সুনামগঞ্জে রমজান মাসে মুনাফা ছাড়া নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য তরুণদের উদ্যোগে দেওয়া দোকানে কেনাকাটা করছেন লোকজন। গতকাল রোববার বিকেলে পৌর শহরের কেন্দ্রস্থল আলফাত স্কয়ার এলাকায়

মুনাফা ছাড়া নিত্যপণ্য বিক্রি করছেন সুনামগঞ্জের একদল তরুণ

রমজান মাস এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। এসব মানুষের কথা চিন্তা করে কোনো মুনাফা ছাড়াই কেনা দামে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রির একটি দোকান দিয়েছেন একদল তরুণ। স্বেচ্ছাশ্রমে দোকানে কাজ করা এই তরুণদের অনেকেই শিক্ষার্থী। তাঁদের সংগঠনের নাম ‘মনুষ্যত্ব ফাউন্ডেশন’।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কেন্দ্রস্থল আলফাত স্কয়ার এলাকায় প্রথম রমজান থেকে চালু হয়েছে এই দোকান। দিন দিন দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে। তরুণদের ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন অনেকে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিতে তাঁদের এই উদ্যোগ। বার্তাটি হলো—এই একটি মাস ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের স্বার্থে কম লাভে পণ্য বিক্রি করতে পারেন এবং ইচ্ছা করলেই সেটি সম্ভব।

রোববার বিকেলে এই দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, আলফাত স্কয়ারের পূর্ব কোণে একটি মার্কেটের তৃতীয়তলায় এটির অবস্থান। বড়সড় একটি কক্ষ। বাইরে ‘মনুষ্যত্বের ন্যায্যমূল্যের দোকান’ লেখা ফেস্টুন টানানো। দোকানের ভেতর ক্রেতাদের ভিড়। পাঁচ-ছয়জন তরুণ ত্রেতাদের পণ্য দিচ্ছিলেন। দোকানে বিভিন্ন জাতের চাল, ডাল, তেল, খেজুর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আলু, আদা, লবণ, হলুদ, ধনিয়া, ময়দা, দুধ, মসলা, বিস্কুট, বেসন, চিনি, চা–পাতা, সাবান, গুঁড়া পাউডার, চিপস, লাচ্ছি, সেমাইসহ নানা সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দামের একটি তালিকাও টানানো আছে। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে বিকেল ৫টা এবং রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তরুণেরা করোনাকালেও শহরের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, স্বেচ্ছায় রক্তদান, অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু ও বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কাজ করেছিলেন তাঁরা। সুনামগঞ্জে ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁরা চালু করেছিলেন ‘মধ্যবিত্তের বিনা মূল্যের দোকান’। এসব উদ্যোগের মূলে আছেন আল মাহমুদ ওরফে রাহী নামের এক তরুণ। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। সুনামগঞ্জে সংগঠনের এসব মানবিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন তাঁর বন্ধু এবং এক সময়ের সহপাঠীরা। অর্থের জোগান দেন আল মাহমুদসহ সংগঠনের সদস্য সবাই মিলে।

দোকানের পুরো কার্যক্রমের বিষয়টি সমন্বয় করেন মিনহাজুর রহমান নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, রোববার সুনামগঞ্জের খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৭০ টাকা কেজি। কিন্তু তাঁরা বিক্রি করছেন ৫০ টাকা কেজি। এই পেঁয়াজ তাঁরা প্রতি কেজি কিনেছেন ৬৬ টাকা ৭০ পয়সা। আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি যেখানে ৯৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে, সেখানে তাঁরা বিক্রি করছেন ৮৫ টাকা। এই পেঁয়াজ তাঁরা কিনেছেন ৮৪ টাকা ৭৫ পয়সা কেজি। একজন ক্রেতাকে দুই কেজির বেশি দিচ্ছেন না তাঁরা। চিনি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১৯ টাকা। তাঁরা বিক্রি করছেন ১১০ টাকা কেজি। মূল্যতালিকায় দেখা গেছে, আতপ চাল ৫৪ টাকা, সেদ্ধ চাল ৫৮ টাকা, পোলাওয়ের চাল ৮৬ টাকা; আলু ২৭ টাকা, আদা ১৮৪ টাকা, রসুন ১৩০ টাকা, মসুর ডাল ১০৫ টাকা, ভুট্টা ডাল ৭২ টাকা, ছোলা ৯৭ টাকা, আটা ৫৫ টাকা, ময়দা ৬৭ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল এক লিটার ১৩৭ টাকা, তেল পাঁচ লিটার বোতল ৭৮৫ টাকা, লবণ ৩৫ টাকা, বেসন ৯০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এই দোকানে।

মিনহাজুর রহমান বলেন, কোনো পণ্যই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে না। কেনা দামের সঙ্গে শুধু পরিবহন ব্যয়টা যুক্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। সংগঠনের সদস্যরাই পাইকারি বাজার থেকে এসব পণ্য কিনে আনেন।

এখন দিনে প্রায় এক লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে বলে জানান মিনহাজুর। মানুষের ভিড় ও বিক্রি—দুটোই বাড়ছে। এটি আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। আলাপের একপর্যায়ে মিনহাজুর বলেন, রমজান উপলক্ষে তাঁরা চাইলে সংগঠনের উদ্যোগে কিছু মানুষকে বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী দিতে পারতেন। কিন্তু অনেকেই আছেন তাঁরা বিনা মূল্যে নেবেন না। মূলত ওই সব মানুষ এই দোকানে আসবেন এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনবেন, এটা চান তাঁরা। এতে কিছুটা হলেও এসব মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হবেন।

ক্রেতাদের জিনিসপত্র দিতে ব্যস্ত থাকেন তরুণ ইমতিয়াজ জোহা, আমির হামজা, জহুরুল ইসলাম, আহমেদ ইমতিয়াজ, মরম আলী, নোমান আহমেদ ও তাওসিফ আনাম। ইমতিয়াজ জোহা বলেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। দামে তো মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এই উদ্যোগ হয়তো বড় কিছু না, কিন্তু একটা উদাহরণ হতে পারে। আমির হামজা বলেন, ‘জিনিসপত্র কেনা, প্যাকেট করা, বিক্রি—সব আমরাই করি। আলাদা কোনো শ্রমিক নেই। কষ্ট হয়, তবু ভালো লাগে।’

জিনিসপত্র কিনে ফেরার সময় এক নারী বলেন, ‘ফেসবুকে দেখে আসছি। দুই লিটার তেল, কিছু আলু আর পেঁয়াজ কিনলাম। কত কমে কিনলাম সেটা বড় না, ছেলেরা যে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে এই চিন্তাটা করছে, এটাই ভালো লাগছে। বাজারের অবস্থা তো ভালো না। মানুষ বড় কষ্টে আছে।’

এই তরুণদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীদের শেখার আছে জানিয়ে শহরের ওয়েজখালী এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, এটি খুব ভালো উদ্যোগ। ব্যবসায়ীরা তো সারা বছরই লাভ করেন, একটা মাস কম লাভ করলে সাধারণ মানুষ বাঁচে।

দোকানেই কথা হয় শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান গিয়াস চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তরুণদের এই শুভ উদ্যোগের খবর পেয়ে দেখতে এসেছি। তারা রমজান মাসে কম মূল্যে মানুষের জন্য নিত্যপণ্য বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি প্রশংসার দাবি রাখে। তারা নিজেরাই বস্তা কাঁধে নিয়ে নিচ থেকে ওপরে তুলছে, ব্যাগভর্তি পণ্য তুলে দিচ্ছে মানুষের হাতে, এটি ভালো লাগার মতো বিষয়।’