শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুড়ী গ্রামের বাসিন্দা মো. ময়নাল হক। গারো পাহাড়ের বালিজুড়ী এলাকায় ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় তিনি এক হেক্টর জমিতে একাশিয়া প্রজাতির ৩ হাজার ৫০০টি চারা রোপণ করেছিলেন। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি এই বাগানের গাছ পরিচর্যা করেছেন। এরপর ২০১৮-১৯ সালে সাড়ে ৯ লাখ টাকায় তাঁর বাগানটি বিক্রি করে বন বিভাগ, যা থেকে তাঁর ৩ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজও সেই টাকা পাননি ময়নাল হক।
ময়নাল হকের মতো বালিজুড়ীতে সামাজিক বনায়নের অন্তত ৩৭ জন অংশীদার দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের পাওনা টাকার জন্য বন বিভাগে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু বন বিভাগ তাঁদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। বালিজুড়ী রেঞ্জের সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামকে গত ৩০ মে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বন বিভাগ। এ খবর প্রকাশ পাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা টাকার জন্য আবারও বন বিভাগে ধরনা দিচ্ছেন। তবে কবে টাকা পাবেন, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
অংশীদার ময়নাল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জানতে পারছি, রবিউল টাকা আত্মসাৎ করছেন। সরকার তাঁকে বরখাস্ত করেছে। চার ছেলে-মেয়ে নিয়া আমার সংসার। এখন টাকা না পাওয়ায় আমি দুশ্চিন্তায় আছি। টাকার অভাবে আমি আমার জরাজীর্ণ ঘর মেরামত করতে পারতাছি না।’
গতকাল বুধবার দুপুরে শেরপুর জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বন বিভাগের বালিজুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়াকে পাওয়া যায়নি। দাপ্তরিক কাজে তিনি ময়মনসিংহে গিয়েছেন বলে জানান বিট কর্মকর্তা মো. আবদুর রউফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রবিউল ইসলামের অর্থ আত্মসাৎ ও সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সামাজিক বনায়নের বেশ কয়েকজন অংশীদার ও উপকারভোগী তাঁদের রেঞ্জ অফিসে এসেছিলেন। তাঁরা প্রাপ্য টাকার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন। কয়েকজন টাকার জন্য আবেদনও জমা দিয়েছেন।
বালিজুড়ী রেঞ্জের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কোষাধ্যক্ষ মো. আবদুল মোতালেব জানান, ২০০৩-২০০৪ সালে বালিজুড়ী রেঞ্জ এলাকার গারো পাহাড়ে ১০০টি বাগান করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ সালে ৬৩ জন অংশীদারকে তাঁদের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ৩৭ জন এখনো টাকা পাননি। তাঁদের পাওনা টাকার পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ টাকা। রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামকে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও অংশীদারেরা তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাননি।
বালিজুড়ী গ্রামের আরেক বাসিন্দা ও সামাজিক বনায়নের অংশীদার মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৩-২০০৪ সালে তাঁকে এক হেক্টর জমির একটি প্লট দেওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রায় তিন হাজার গাছ লাগানো হয়েছিল। বন্য হাতির আক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা করেছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ লাখ টাকায় বাগান বিক্রি করা হয়। কিন্তু বাগানের বিক্রিত কোনো টাকা আজ পর্যন্ত তিনি পাননি। মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সাত-আট মাস আগে ময়মনসিংহে গিয়ে ডিএফও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু তাতেও কাজ হয় নাই। টাকা না পাইলে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
বালিজুড়ী গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুস সাত্তার, মোছা. মহিমা বেগম, মো. মনিরুজ্জামানসহ সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির একাধিক অংশীদার প্রথম আলোকে বলেন, রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল অত্যন্ত বেপরোয়া মনোভাবের ছিলেন। তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর কাছে কোনো অংশীদার সামাজিক বনায়নের টাকা একাধিকবার চাইতে গেলে তিনি (রবিউল) বন আইনে মামলা দিয়ে ওই অংশীদারকে হয়রানি করতেন। দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের জন্য রবিউলের বিচার দাবি করেন এসব গ্রামবাসী।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রবিউল ইসলাম ২০১৬ সালে বালিজুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে জামালপুর জেলায় বদলি করা হয়। তিন মাস আগে বালিজুড়ীর নতুন রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে সুমন মিয়া যোগ দেন। এরপরই সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি প্রকাশ পায়।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে বালিজুড়ী রেঞ্জের দুই শতাধিক সামাজিক বনায়নের বাগান দরপত্রের মাধ্যমে ১৬ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। রবিউল ইসলাম যার মধ্যে ৯ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন বলে তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে।
শ্রীবরদী উপজেলার মালাকোচা গ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী নুর আলম বলেন, তিনি বাগানের লট কেনার সাড়ে চার লাখ টাকা রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউলের কাছে জমা দিলেও তাঁকে কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি। এখন বন বিভাগ তাঁকে টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ দিয়েছে।
শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক সাদেকুল ইসলাম খান বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, রবিউল ইসলামের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দুটি কমিটি তদন্ত করে দেখছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে রবিউলের ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিগগিরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। এরপর আইনানুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া যেসব অংশীদার টাকা পাননি, তাঁদের টাকা পরিশোধের বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।