পাবনার বেড়া উপজেলার খাস আমিনপুর গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে সুতা রং ও প্রক্রিয়া করার চারটি কারখানা। এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে আত্রাই নদে ফেলায় দূষিত হয়ে পড়েছে পানি। বর্ষা চলে আসায় নদীর পানির মাধ্যমে বিষাক্ত বর্জ্য খাস আমিনপুরসহ অন্তত পাঁচটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিষাক্ত বর্জ্যের পানি মাছের ঘেরে ঢুকে গত শুক্রবার ও শনিবার এই দুই দিনে অর্ধকোটি টাকার মাছ মারা গেছে। এসব গ্রামের মানুষের দেখা দিয়েছে চুলকানি, চর্মরোগ ও পেটের পীড়া। হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। অনেক বাড়ির হাঁস-মুরগি, গাছ ও খালের মাছ মরে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, খাস আমিনপুর গ্রামে আত্রাই নদের পূর্ব পারে আট থেকে ১০ বছরে চারটি প্রসেস মিল গড়ে উঠেছে। কাবুল মণ্ডল, সাবান মোল্লা, রফিকুল ইসলাম ও বাবু মোল্লা এসব কারখানার মালিক। কারখানাগুলোতে সুতা রং ও প্রক্রিয়া করা হয়। এসব কাজ করার জন্য কারখানায় ব্যবহার করা হয় নাইট্রিক অ্যাসিড, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, কস্টিক সোডা, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড, লবণসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। এতে প্রতিদিনই কারখানা থেকে বের হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত বর্জ্য। সেই বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা না করেই সরাসরি ফেলা হচ্ছে পাশের আত্রাই নদে। সেখান থেকে বর্জ্য অন্তত পাঁচটি গ্রামের ছড়িয়ে পড়ছে।
পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে যে গোসল করা তো দূরের কথা সেই পানিতে কেউ নামলেই চুলকানিসহ চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।
বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় কারখানার মালিকেরা কারখানার পাশে কূপ বা ছোট খালের মতো তৈরি করে বর্জ্য জমিয়ে রাখেন। এসব কূপ ও খাল ভরে যাওয়া মাত্রই সেখান থেকে তা নদীতে ফেলা হয়। বর্ষা বাদে অন্য সময়ে নদীতে তেমন পানি না থাকায় বিষাক্ত বর্জ্য খুব বেশি ছড়াতে পারেন না। কিন্তু বর্ষা মৌসুম আসা মাত্রই বৃষ্টির কারণে কূপ ও খাল ভরে ওঠায় মালিকেরা জমানো বর্জ্য নদীতে ফেলতে থাকেন। এবারও কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলা শুরু হয়েছে।
নদীর পানি বাড়ায় এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যসহ আশপাশের মাছের ঘেরে ঢুকে পড়ছে। একটি ঘেরের মালিক কবির হোসেন বলেন, প্রতিবছর এই প্রসেস মিলের বিষাক্ত বর্জ্যে তাঁদের মৎস্যঘেরের চাষ করা মাছ মারা যাচ্ছে। এবারও বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে তাঁর ঘেরের ২৫ লাখ টাকার মাছ মারা গেছে।
প্রসেস মিলের কাছে আত্রাই নদে আছে ফিরোজ মিয়ার মৎস্যঘের। ফিরোজ মিয়া বলেন, বিষাক্ত বর্জ্যের পানি তাঁর ঘেরে প্রবেশ করে গত শুক্রবার অন্তত ২৫ লাখ টাকার মাছ মারা গেছে। এ ঘটনায় ঘেরমালিকদের পক্ষে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
আমিনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন-উর রশীদ বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এলাকাবাসী জানান, বিষাক্ত বর্জ্যে মারা যাওয়া ঘেরের মাছ ধরতে গিয়ে স্থানীয় দুই শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের গায়ে ফোসকা দেখা দেয় ও বমি হতে থাকে। দুই শিশুকে একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
প্রসেস মিলের বিষাক্ত বর্জ্য মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ থেকে লিভার, কিডনি, ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্রের রোগসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।মাহমুদুল করিম, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
চারটি কারখানার মধ্যে তিনটি আমিনপুর বাজারের কাছে ও একটি গ্রামের মধ্যে। সব কারখানাই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। গত শনিবার আত্রাই নদের পূর্ব দিকে খাস আমিনপুর গ্রামে ঢুকতেই ঝাঁজালো ও উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়। নদীতে নতুন পানি এলেও পানি গাঢ় কালো ও কুৎসিত বর্ণ ধারণ করেছে। গ্রামের কবির হোসেনের মৎস্য ঘেরে গিয়ে প্রচুর মাছ মরে ভেসে থাকতে দেখা গেল। আলাপকালে গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কারখানাগুলোর বর্জ্যের কারণেই নদীর পানির এ অবস্থা।
খাস আমিনপুর গ্রামের জিয়াউর রহমান, ফরিদউদ্দিন, বাবুসহ ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, দুর্গন্ধে বসবাস করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে যে গোসল করা তো দূরের কথা সেই পানিতে কেউ নামলেই চুলকানিসহ চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।
বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মাহমুদুল করিম জানান, প্রসেস মিলের বিষাক্ত বর্জ্য মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ থেকে লিভার, কিডনি, ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্রের রোগসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
চারটি প্রসেস মিলের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারখানাটির মালিক কাবুল মণ্ডল। তাঁর কারখানার বর্জ্যেই এলাকার পরিবেশ সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। এলাকাবাসীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে গত বছর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কাবুল মণ্ডলকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। সেই সঙ্গে বর্জ্য নদীতে না ফেলার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। কিন্তু এর পরেও নদীতে বর্জ্য ফেলা থামেনি।
কাবুল মণ্ডলের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করা হলে তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহা. মোরশেদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি শুনেছেন। দ্রুত এ ব্যাপারে তিনি আইনি পদক্ষেপ নেবেন।