গত এক সপ্তাহে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভেসে আসে বিপন্ন অলিভ রিডলে জাতের ছয়টি মা কচ্ছপের মৃতদেহ।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন বেশ কয়েক প্রজাতির কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র। কয়েক বছর আগেও ডিম পাড়ার জন্য গভীর সমুদ্র থেকে ছুটে আসত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মা কচ্ছপ। তবে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পর্যটকের উপস্থিতি ও দূষণের কারণে কচ্ছপের নিরাপদ প্রজননক্ষেত্রটি ধ্বংসের মুখে পড়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সৈকতের বালিয়াড়িতে ছয়টি মা কচ্ছপের মৃতদেহ ভেসে এসেছে।
গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসতে শুরু করেছে। তবে নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় মা কচ্ছপের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। গত এক সপ্তাহে সেন্ট মার্টিন সৈকতে ভেসে আসা কচ্ছপগুলোর সবই বিপন্ন অলিভ রিডলে প্রজাতির। ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ওজনের এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
জেলেরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ১০-১২ কিলোমিটার দূরে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ফেলে পোপা, লইট্যা, ফাইস্যা, ছুরি, ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরেন। এ সময় অসংখ্য কচ্ছপ জালে আটকা পড়ে। কচ্ছপ আটকা পড়লে জাল ছিঁড়ে যায় বলে জেলেরা সেগুলোকে পিটিয়ে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেন।মোহাম্মদ উল্লাহর, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেলে
বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে সেন্ট মার্টিনের উত্তর সৈকতে ভেসে আসে ৩৫ কেজি ওজনের একটি মা কচ্ছপ। এর আগে ২৩ জানুয়ারি দ্বীপের পশ্চিম সৈকত অংশে একটি, ২০ জানুয়ারি উত্তর সৈকতে একটি, ১৮ জানুয়ারি কোনাপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার সৈকতে দুটি এবং ১৭ জানুয়ারি দ্বীপের গলাচিরা এলাকার সৈকতে একটি মা কচ্ছপের মৃতদেহ ভেসে আসে।
টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কচ্ছপ সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা কোডেক। এই সংস্থার নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও গবেষক শীতল কুমার নাথ বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এ এলাকায় জলপাইরঙা বা অলিভ রিডলে কচ্ছপ বেশি দেখা যায়। এই জাতের কচ্ছপকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন)।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা। এ ধরনের সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে। তবে সৈকত এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে এসব বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না।নারায়ণ দাশ, নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক
কচ্ছপের যত বিপদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান কক্সবাজার এলাকায় কচ্ছপের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপ ধ্বংসে ১১টি ঝুঁকি চিহ্নিত করেন। এসব হলো, অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কক্সবাজার সৈকতে কাছিমের আবাসস্থল ধ্বংস করা, নিষিদ্ধ কারেন্ট ও টানা জালের ব্যবহার, সৈকত এলাকায় যথেচ্ছ আলোকায়ন, জালে আটকে পড়া মা কাছিম মেরে ফেলা, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে সৈকতে ডাইভিং, খেলাধুলা ও ডিম পাচার প্রভৃতি।
আবার সেন্ট মার্টিন সৈকতের কাছে সাগরে জেলেরা প্রায়ই কারেন্ট ও বিহিঙ্গি জাল পেতে রাখেন। এ ছাড়া গভীর সাগরে বড় ফিশিং বোটের ট্রলিং জালের ব্যবহারও বেড়েছে। এই তিন জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ। আবার জাল ডিঙিয়ে কিছু কচ্ছপ সৈকতে এসে ডিম পাড়তে পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে বেওয়ারিশ কুকুর।
নিষিদ্ধ জাল কোথায় ও কীভাবে ব্যবহার হয়, তা জানা গেল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেলে মোহাম্মদ উল্লাহর (৪২) কাছ থেকে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জেলেরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ১০-১২ কিলোমিটার দূরে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ফেলে পোপা, লইট্যা, ফাইস্যা, ছুরি, ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরেন। এ সময় অসংখ্য কচ্ছপ জালে আটকা পড়ে। কচ্ছপ আটকা পড়লে জাল ছিঁড়ে যায় বলে জেলেরা সেগুলোকে পিটিয়ে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেন। এ ছাড়া সেন্ট মার্টিনের নাইক্ষ্যংদিয়া চ্যানেলে পেতে রাখা হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি জাল। প্রতিদিন এসব জালে কচ্ছপ মারা যাচ্ছে।
জনবল নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কচ্ছপ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অধিদপ্তরের সেন্ট মার্টিন কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক ফায়জুল কবির বলেন, ‘এখানে আমাদের কোনো কর্মকর্তা নেই। দুজন কর্মী রয়েছেন। তাঁরা সৈকত থেকে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে একটি হ্যাচারিতে বালুচাপা দিয়ে রাখেন। ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে সেগুলো সমুদ্রে ছেড়ে দেন।’
ফায়জুল কবির আরও বলেন, সৈকতের পাড়ে গড়ে ওঠা স্থাপনায় আলোকায়ন ও পর্যটকের হাঁটাচলার কারণে আগের তুলনায় মা কচ্ছপ ডিম ছাড়তে কম আসছে। যারা আসছে তারাও কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। কিন্তু জনবলসংকটে কিছুই করা যাচ্ছে না।
কচ্ছপ রক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) ‘নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের’ আওতায় কচ্ছপ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের মাদারবুনিয়া থেকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের খুরের মুখ পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলে কচ্ছপ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের আওতায় কচ্ছপ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে স্থানীয় জনসাধারণ ও জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে কচ্ছপের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সমুদ্র উপকূলের ৪০ কিলোমিটার এলাকায় এ পর্যন্ত পাঁচটি কাছিমের হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে। ডিম রক্ষায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১০ জন পাহারাদার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বালুকাময় সৈকতের একটি নির্দিষ্ট স্থান সংরক্ষণ করতে হবে, যেখানে মা কচ্ছপ এসে ডিম পাড়তে পারবে। সেখানে কুকুরের আনাগোনা থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে কোডেক নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক নারায়ণ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা। এ ধরনের সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে। তবে সৈকত এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে এসব বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। বিধিমালা অনুসরণ করা হলে বিপন্ন কচ্ছপ রক্ষা সহজ হবে।