রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

বিদায় সংবর্ধনার নামে টাকা তুলতে টেবিল পেতেছে ছাত্রলীগ

প্রশাসন ভবনে ব্যানার ঝুলিয়ে টেবিল চেয়ার পেতে টাকা নিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতা– কর্মীরা। সোমবার দুপুরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের যে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের বিদায় অনুষ্ঠানের নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে কেটে নিচ্ছে পলিটেকনিক শাখার ছাত্রলীগ। আজ সোমবার ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে টেবিল পেতে বসেছে। বুধবার পর্যন্ত টাকা আদায় চলবে।

পলিটেকনিক কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিদায় অনুষ্ঠানের নামে টাকা আদায়ের বিষয়ে তাদের কোনো সম্মতি নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ২০ জানুয়ারির পর এই অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। তখন কেউ ক্যাম্পাসে থাকবেন না। এই টাকায় কোনো অনুষ্ঠানও হবে না। তাঁদের আশঙ্কা, পলিটেকনিক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন।

পলিটেকনিক সূত্রে জানা গেছে, আটটি বিভাগের অষ্টম পর্বের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ (ইন্টার্নশিপ) ভাতা ও জামানতের টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে আজ সোমবার। এর মধ্যে আজ সকালে সিভিল, দুপুরে পাওয়ার এবং বিকেলে কম্পিউটার বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের টাকা দেওয়া হয়। মঙ্গলবার ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রো মেডিকেল এবং বুধবার মেকানিক্যাল, ইলেকট্রনিকস ও মেকাট্রনিকস বিভাগের টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে। এই আট বিভাগের ১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর সবাই ইন্টার্নশিপের ১৩ হাজার ও জামানত রাখা ৪০০ টাকা করে ফেরত পাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা ১২ হাজার ২৫০ টাকা পাচ্ছেন।

ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, সম্মেলনকক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। ১৩ হাজার ৪০০ টাকা থেকে কোর্স সমাপনী সার্টিফিকেট বাবদ কর্মচারীরা ৫০ টাকা আর মসজিদের উন্নয়নের জন্য ১০০ টাকা করে নিচ্ছেন মুয়াজ্জিন আবদুল আলীম। সম্মেলনকক্ষের পাশেই চেয়ার-টেবিল পেতে বসে আছেন ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীরা। সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের তাঁরা বিদায় অনুষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করতে বাধ্য করছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে ফরম পূরণ করে ১ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এই টাকা আদায় করা নিয়ে কড়া তদারকি করছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা একসঙ্গে পাঁচজন করে শিক্ষার্থীকে ভেতরে ঢোকাচ্ছেন। টাকা নিয়ে বের হলেই বিদায় অনুষ্ঠানের ফরম পূরণ করানো হচ্ছে।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের এক কর্মী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জীহান ও সাধারণ সম্পাদক রানা হোসেনের কাছে নিয়ে যান। জীহান বললেন, প্রতিটি বিভাগের ক্যাপ্টেন তাঁদের (ছাত্রলীগ) টাকা আদায় করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ কারণে তাঁরা টাকা তুলছেন। অনুষ্ঠান ২০ জানুয়ারি। প্রত্যেককে এ বিষয়ে টোকেন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিজেও ফরম পূরণ করে টাকা দিয়েছেন বলে জানান জীহান। টেবিলের মুড়িতে অবশ্য তাঁর ফরম পাওয়া যায়। এতে লেখা রয়েছে, ‘রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অষ্টম পর্বের বিদায় সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ২০২৪ ’। নামের জাগায় লেখা রয়েছে, ‘জীহান ভাই (সভাপতি), টাকার পরিমাণ ১০০০।’

সাধারণ ছাত্ররা বলছেন অন্য কথা। তাঁদের দাবি, বিদায় সংবর্ধনা আয়োজনের কথা তাঁরা বলেননি। হঠাৎ ছাত্রলীগকে এভাবে টাকা নিতে দেখছেন তাঁরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্যাপটেন বলেন, ‘আমরা তো আগে কিছু জানতাম না। আজই দেখছি সংগঠনের (ছাত্রলীগ) ছেলেরা এভাবে টাকা আদায় করছেন। কারা দায়িত্ব দিয়েছেন, জানি না।’

ক্যাম্পাসে ঢুকছিলেন সিভিল বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘বিদায় অনুষ্ঠানের জন্য টাকা দিতে হবে, এটা জানি না। টাকা তুলতে গেলে বুঝতে পারব।’ আরেকজন বললেন, সবাই দিচ্ছেন, তাই তিনিও দিলেন। ক্যাম্পাস থেকে চলে যাচ্ছেন। তবে যেহেতু টাকা দিয়েছেন, তাই অনুষ্ঠান হলে আসার চেষ্টা করবেন।

তবে এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ গতকাল রাত ৯টা ২০ মিনিটে জানান, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের ব্যানারেই হবে, বড় ভাই হিসেবে ছাত্রলীগ সহযোগিতা করছে মাত্র।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোহম্মদ আবদুর রশীদ মল্লিক তখন ছিলেন না। পরে মুঠোফোনে তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক-কর্মচারীর সামান্যতম সম্মতি নেই। কারণ, এই ছাত্ররা চলে যাচ্ছেন। তাঁদের আর অনুষ্ঠান করতে আসার সুযোগ নেই। আগেও কখনো এমনটা করা হয়নি। যাঁদের বাড়ি শহরে, তাঁরা আসতে পারেন।

অনুষ্ঠান করার জন্য টাকা তুলে দিতে প্রস্তাব পেয়েছিলেন জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, তিনি তখন স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারবেন না। কারণ, যে ছাত্র ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য কিসের অনুষ্ঠান। তাঁদের তো প্রতিষ্ঠানে আর থাকার কোনো সুযোগ নেই। এরপরও গায়ের জোরে টাকা তোলা হচ্ছে বলে শুনেছেন বলে জানান অধ্যক্ষ।

কেউ কোনো অভিযোগ না করার কারণে এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলে দাবি করেন আবদুর রশীদ। তিনি বলেন, যে রসিদ দেওয়া হচ্ছে, সেটা ওরাই (ছাত্রলীগ) বানিয়েছে। এই টাকা দেওয়া উপলক্ষে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ১১ জানুয়ারি পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সকালে পুলিশ এসেছিল, তারপর চলে গেছে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলাম বলেন, পলিটেকনিক কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে পুলিশ চেয়েছিল। নগরের চন্দ্রিমা থানার পুলিশ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিল। কোনো ঝামেলা হয়নি।