খুলনার কয়রায় বাঁধ নির্মাণে ক্ষতিপূরণ না দিয়েই অপরিকল্পিভাবে কৃষকের ফসলি জমি কেটে নেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হারেজখালি এলাকায়
খুলনার কয়রায় বাঁধ নির্মাণে ক্ষতিপূরণ না দিয়েই অপরিকল্পিভাবে কৃষকের ফসলি জমি কেটে নেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হারেজখালি এলাকায়

কয়রায় ঠিকাদারের প্রতারণায় দিশাহারা কৃষক

খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ‍ বেদকাশি ইউনিয়নের হারেজখালী এলাকায় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদারের কারসাজিতে নিঃস্ব হতে বসেছে শতাধিক কৃষক পরিবার। প্রথমে চিংড়ি চাষের কথা বলে কৃষকের ফসলি জমি ইজারা নেন ঠিকাদার। এরপর সেখান থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। জমির মালিকদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। এখন কৃষকেরা বাধা দিলে তাঁদের হুমকি দিচ্ছেন ঠিকাদার।

ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে গত মঙ্গলবার লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী জমিমালিকেরা। ইউএনও এ বি এম তারিক উজ জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত জমিমালিকদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তাঁরা মালিকানাধীন জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ার বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের পাতাখালী ও জোড়শিং গ্রামের মাঝে হারেজখালী এলাকায় ২ হাজার ৮১১ মিটার নতুন বাঁধ নির্মাণের জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। মেসার্স মোজাফফর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে। সাব-ঠিকাদার হিসেবে ইসরাফিল হোসেন এলাকায় কাজটি করছেন বলে জানা গেছে।

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, পাতাখালী ও জোড়শিং গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। দুই গ্রামের সংযোগস্থলকে বলা হয় হারেজখালী এলাকা। সেখানে প্রায় তিন কিলোমিটার ঘুরিয়ে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। ইসরাফিল হোসেন সেখানে সাতটি খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে বাঁধের ওপরে তুলছেন। দেখা গেছে, মূল বাঁধের স্থান থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে নতুন বাঁধ নির্মাণ করায় প্রায় ৪০০ বিঘা ফসলি জমি নতুন বাঁধের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, বাঁধটি যদি সোজাভাবে পুরোনো বাঁধের ওপর দিয়ে করা হতো, তাহলে একদিকে তাঁদের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি রক্ষা হতো, অন্যদিকে নির্মাণ ব্যয়ও কমে আসত কয়েক গুণ।

জোড়শিং গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাঁধটি সোজাসুজি করা হলে এর দৈর্ঘ্য হতো এক কিলোমিটার। কিন্তু বাঁধ ঘুরিয়ে করায় দৈর্ঘ্য বেড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার হয়েছে। ফলে ব্যয়ও বেড়েছে। বিষয়টি পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েক শ বিঘা ফসলি জমি বাঁধের বাইরে রেখে ফায়দা নিচ্ছেন ঠিকাদার। কম টাকায় তাঁরা ওই জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষের কথা বলে মাটি কেটে নিচ্ছেন। এটা একধরনের প্রতারণা।

ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ, বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন এসে জমিমালিকদের নানা প্রলোভন দেখাতে শুরু করেন। চিংড়ি চাষের জন্য প্রতি বিঘা জমি তিন হাজার টাকা হারে ইজারা নিয়ে প্রথমে সেখানে এক কিলোমিটারের মতো প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করেন ঠিকাদার। পরে অপরিকল্পিতভাবে খননকাজ শুরু করেন তাঁরা। ঠিকাদারের কারসাজি বুঝতে পেরে জমির মালিকেরা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য গোলাম কিবরিয়াকে নিয়ে খননকাজে বাধা দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঠিকাদারের পক্ষে ওয়াজেদ আলী চাকলাদার ওই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদা দাবির অভিযোগ করেন। 

ইউপি সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, চিংড়ি চাষের কথা বলে এলাকার শতাধিক কৃষকের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে খননকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার। বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ করা হয়েছে।

হারেজখালী এলাকার কাশেম খাঁ বলেন, ‘আমার তিন বিঘা জমি খনন করে মাটি নেওয়া হয়েছে। যেভাবে জমি খনন করা হয়েছে, সেখানে অন্তত ১০ বছরেও ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে না। খননকাজে বাধা দিলে ঠিকাদারের লোকজন নানা ভয়ভীতি দেখায়।’

এ ব্যাপারে কথা বলতে সাব–ঠিকাদার ইসরাফিল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোজাফফর এন্টারপ্রাইজের মালিক মোজাফফর হোসেন বলেন, ইফরাফিল নামের একজনকে কাজটি সাব-ইজারা দেওয়া হয়েছে। জমিমালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এমন কোনো নির্দেশনার ব্যাপারে তাঁর জানা নেই।

পাউবো সাতক্ষীরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিকুর রহমান বলেন, জমিমালিকদের সঙ্গে আপস না করে সেখান থেকে মাটি কাটা যাবে না। কারও জমি থেকে মাটি নিতে হলে তাঁকে সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে এই প্রকল্পে। অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।