বাংলাদেশ রেলওয়ের দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর ফরিদপুর বা খুলনার মধ্যে কোথায় হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। অন্য তিনটি সদর দপ্তর ইতিমধ্যে নির্ধারিত হলেও দক্ষিণের সদর দপ্তর নির্ধারণ নিয়ে চলছে জটিলতা।
তবে এ বিষয়ে সম্প্রতি গঠিত রেলওয়ের একটি কমিটি প্রশাসনিক কাঠামো বিবেচনায় খুলনায় দক্ষিণের সদর দপ্তর করার জন্য কয়েকটি যুক্তিসহ মতামত দিয়েছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে সদর দপ্তরের পাশাপাশি বিভাগীয় কার্যালয়ও খুলনায় করার জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের একটি কপি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কাছে আছে।
দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর নির্ধারণে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের নির্দেশে গত ১২ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন রেলওয়ের রাজশাহীর মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার। ২৭ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
অসীম কুমার তালুকদার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি আসলে দক্ষিণাঞ্চলে সদর দপ্তর স্থাপনের ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। আমরা সেটি মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা ও ফরিদপুরের মধ্যে কোন জেলায় সদর দপ্তর করা হবে, তা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে জল ঘোলা হচ্ছে। সাবেক রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালক, জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে বারবার প্রভাবিত করেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের ৯ বছর পরও রেলওয়ের দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তরের স্থানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য তখন তিনি রেলওয়ের দুটি অঞ্চলকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করার কথা বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা থেকে গঠিত কমিটি বাংলাদেশ রেলওয়ের অধিক্ষেত্রকে চারটি অঞ্চল ও নয়টি পরিচালন বিভাগে ভাগ করার সুপারিশ করে। তখন রেলওয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর ধরা হয় ফরিদপুর এবং এর পরিচালনা বিভাগ ধরা হয় রাজশাহী, যশোর ও বরিশালকে। তবে সে সময়কার রেলওয়ের মহাপরিচালক চারটি অঞ্চল ও আটটি পরিচালনা বিভাগের সুপারিশ করেন। তাঁর সুপারিশকৃত দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর ধরা হয় খুলনা এবং এর পরিচালনা বিভাগ ধরা হয় খুলনা ও ফরিদপুরকে।
খুলনা ও ফরিদপুরের মধ্যে কোন জেলায় সদর দপ্তর করা হবে, তা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে জল ঘোলা হচ্ছে। সাবেক রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালক, জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে বারবার প্রভাবিত করেছেন।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ওই দুজনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা করে আরও একটি সুপারিশ করা হয়। এতে রেলওয়ের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের কাঠামোতে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়। দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর ফরিদপুরকে ধরে এর পরিচালনা বিভাগ রাখা হয় খুলনা ও রাজবাড়ী। সর্বশেষ ওই প্রস্তাবনা অনুযায়ী জনবল নিয়োগ ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রস্তুত করা হচ্ছিল। তবে গত মার্চে খুলনা ও বাগেরহাটের তিনজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য খুলনায় সদর দপ্তর করার প্রস্তাব করলে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এরপর রেলওয়ের মহাপরিচালকের নির্দেশে ১২ সেপ্টেম্বর নতুন করে কমিটি গঠন করা হয়।
খুলনায় রেলওয়ের দক্ষিণাঞ্চল সদর দপ্তর করার জন্য নতুন কমিটি কিছু যুক্তি তুলে ধরেছে। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম ও পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী শহরে অবস্থিত। স্বভাবতই নতুন সৃষ্ট অন্য দুটি অঞ্চলের সদর দপ্তর বিভাগীয় শহরে হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত। তা ছাড়া খুলনা একটি পুরোনো বাণিজ্যিক শহর। বর্তমানে খুলনা থেকে মোংলা, খুলনা থেকে বাগেরহাট, নাভারন থেকে মুন্সিগঞ্জ, দর্শনা থেকে মেহেরপুর, খুলনা থেকে ফকিরহাট ও বাগেরহাট রেললাইন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। আবার ভবিষ্যতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলায় রেলপথ সম্প্রসারিত হবে। এসব অঞ্চলের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে খুলনা অবস্থিত। তাই খুলনায় দক্ষিণের সদর দপ্তর হলে রেলওয়ের পর্যবেক্ষণ সহজ হবে। এর বাইরে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নড়াইল, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত রেললাইন স্থাপন মনিটরিং, দুর্ঘটনাজনিত উদ্ধারকাজ সম্পাদনে দ্রুত রিলিফ ট্রেন পাঠানো সম্ভব হবে।
খুলনা শহরে রেলওয়ের অনেক স্থাপনা ও ভূমি আছে। আঞ্চলিক ও বিভাগীয় কার্যালয় নির্মাণের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না বলে যুক্তি দেখিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। ফরিদপুরে সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য যে জনবল কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা খুলনা অঞ্চলের জন্য বহাল থাকবে বলে মতামত দিয়েছেন তাঁরা।
কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু সরাসরি রেলমন্ত্রী একটা সুপারিশ করেছিলেন, তাই নতুন কমিটি সংশ্লিষ্টরা ওই সুপারিশের বাইরে যাওয়াকে অন্যভাবে দেখছেন। এ কারণে কমিটির সদস্যরা আলাদাভাবে কোনো সুপারিশ করেননি। তাঁরা প্রতিবেদনে কিছু যুক্তি দিয়ে মতামত তুলে ধরেছেন।