তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন কক্সবাজারের ৫ উপজেলা, খাওয়ার পানির সংকট

ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে গাছ পড়ে বিদ্যুতের তার ও খুঁটি ভেঙে পড়েছে। তিন দিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন কক্সবাজারের পাঁচ উপজেলা। আজ সন্ধ্যায়ও বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় হামুন কক্সবাজারে আঘাত হানে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কক্সবাজার পৌরসভাসহ সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়ায় তাণ্ডব চালায়। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। এতে জেলার অন্তত ৯ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি এলাকায় খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে জেলার ৯ উপজেলা ও দুই পৌরসভায় ৪২ হাজার ৯৫৯টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৫ হাজার ১০৫টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৭৪৯টি ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ। প্রায় ৮০০ স্থানে গাছ পড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। ৩৫৪টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়েছে, বিকল হয়েছে ২৩টি ট্রান্সফরমার। এসব কারণে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজার পৌরসভার অর্ধেক অংশ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও সদর উপজেলায় বিদ্যুৎ–সংযোগ পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ঝড়ে দেয়াল ও গাছ চাপা পড়ে তিনজন মারা গেছেন।

আজ দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দরপাড়া, ফদনারডেউল, বাসিন্যাপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, নুনিয়ারছটা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনো অর্ধশতাধিক পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ২০০ পরিবারকে ঢেউটিন ও নগদ অর্থসহায়তা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। আজ কয়েকটি পরিবারকে ঢেউটিন দিয়ে নতুন করে ঘর তুলতে দেখা যায়।

ফদনারডেইল এলাকার গৃহবধূ সামছুন নাহার বলেন, ঝড়ের তাণ্ডবে মঙ্গলবার রাতে তাঁর ঘর বিধ্বস্ত হলে পাশের আরেকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় মোটর দিয়ে পানি তোলা যাচ্ছে না। দুই দিন পরিবারের লোকজনের গোসল বন্ধ। দূরের পুকুর থেকে ময়লা পানি এনে রান্নাবান্নার কাজ সামলাতে হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে লন্ডভন্ড কক্সবাজার শহরের সমুদ্রউপকূলীয় বন্দরপাড়া। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত গ্রামের অনেকে ত্রাণসহায়তা পাননি

১ নম্বর ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামে ৭০ হাজারের বেশি শ্রমজীবী মানুষের বসতি। নাজিরারটেক উপকূলে গড়ে ওঠা শুঁটকিমহালে তাঁরা কাজ করেন। তিন দিন ধরে অনেকে ত্রাণ ও গৃহনির্মাণসামগ্রী না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। ঘূর্ণিঝড়ে এসব গ্রামের চার শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও পাঁচ শতাধিক ঘর।

বিদ্যুৎ না থাকায় শহরের এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, গোলদিঘির পাড়া, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, লারপাড়া, আলীর জাহালসহ অন্তত ৩০টি মহল্লায় খাওয়ার পানির সংকট চলছে। মোটর দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে না পারায় বাসাবাড়ির ভাড়াটেরাও পানি পাচ্ছেন না। সচ্ছল পরিবারের লোকজন বাজার থেকে খাওয়ার পানি কিনে খেলেও অনেকে গোলদিঘি, বাজারঘাটার দিঘির পানি ব্যবহার করছেন।

ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত দুই হাজার পরিবারে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট চলছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গভীর নলকূপ থেকে মোটর দিয়ে পানি তোলা যাচ্ছে না। অধিকাংশ লোক গোলদিঘির পানি ব্যবহার করছেন। এতে নারী-শিশুসহ বাসিন্দাদের রোগবালাইয়ের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

পাহাড়তলী এলাকার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, তিন দিন ধরে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ থাকায় বিদেশের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ না থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে হেলে পড়া বিদ্যুতের খুঁটি এখনো ডোবায় পড়ে আছে। শুক্রবার কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার হরিনাফাঁড়ি এলাকায়

বিদ্যুৎ না থাকায় শহরের অর্ধেক এলাকায় বাসাবাড়িতে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট চলছে জানিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, পৌরসভার পাইপলাইন দিয়ে কয়েক শ পরিবারে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যান্য এলাকায় দ্রুত বিদ্যুৎ–সংযোগ স্বাভাবিক করার জন্য কাজ করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা। তিনি বলেন, ঝড়ে পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে অন্তত ৩০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ১ হাজার। ইতিমধ্যে ১৫ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ঢেউটিন ও ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণি বলেন, ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের অর্ধেকের বেশি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেও ঝাউতলা, বাহারছড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ না থাকায় মানুষজনের নানামুখী সমস্যা ও দুর্ভোগ হচ্ছে। সংকট নিরসনে তাঁরা কাজ করছেন।

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুতের খুঁটি এবং তার ছিঁড়ে পড়ায় তিন দিন ধরে অন্ধকারে আছেন সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দারা। এর মধ্যে কুতুবদিয়ায় পিডিবির আওতাধীন, অন্য উপজেলায় বিদ্যুৎ দেয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।

নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণি বলেন, সব জায়গায় গাছ পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। হাজারো স্থানে তার ছিঁড়ে গেছে। গাছ কেটে বিদ্যুতের খুঁটি পুনঃস্থাপন এবং ছিঁড়ে যাওয়া তার ঠিক করে সংযোগ দিতে সময় লাগছে।