মেলায় হাজারো মানুষের ভিড়। বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নুনের টেক লালপুরীর মেলায় ছবি: প্রথম আলো
মেলায় হাজারো মানুষের ভিড়। বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নুনের টেক লালপুরীর মেলায় 

ছবি: প্রথম আলো

মেঘনার চরের বড় উৎসব ‘লালপুরীর মেলা’

হেমন্তের রাত। লাল গামছা গলায় ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হাঁক দিয়ে বলেন, ‘মাঝি লইয়া যাও।’ বিকট যান্ত্রিক শব্দে নদীতে ভাসে ট্রলার। ফেলে আসা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার খেয়াঘাটে তখন মানুষের ভিড়। একের পর এক যাত্রীবোঝাই ট্রলার ঘাট ছাড়ছে। সবার গন্তব্য মেঘনার চরের ‘লালপুরীর মেলা’।

অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলা ট্রলারে কথা হয় সেই ব্যক্তির সঙ্গে। জানালেন, তাঁর নাম মো. মোজাম্মেল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদী গ্রামে তাঁর বাড়ি। ট্রলারের অন্য সব যাত্রীর মতো মোজাম্মেলও যাচ্ছেন মেঘনার বুকে ভেসে ওঠা চর নুনের টেকে। চারপাশে মেঘনা ঘেরা সোনারগাঁয়ের বারদী ইউনিয়নের সেই চরে চলছে ‘মওলানা নুরুল ইসলাম লালপুরীর ৫১তম ওরশ’। মানুষের কাছে যা পরিচিত ‘লালপুরীর মেলা’ নামে।

মেলায় বাহারি খেলনার পসরা সাজানো হয়েছে

মোজাম্মেল বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে প্রতিবছর মেলায় আসেন তিনি। মেলায় আসা পাগল-মুসাফিরদের সাক্ষাৎ পেয়ে মনে শান্তি পান।

মিনিট দশেকের যাত্রায় ট্রলার গন্তব্যের কাছাকাছি। কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার মেঘনার বুকে ঝলমল করছে রংবেরঙের আলো। তীরে ভিড়ানো শত শত ট্রলার-লঞ্চ। দূরদূরান্ত থেকে এসব নৌযানে করে ভক্তরা মেলায় এসেছেন। কোনো কোনো নৌযানের সামনে বড় বড় পাতিলে খিচুরি রান্না হচ্ছে।

নদীর তীর ঘেঁষে তৈরি কাপড়ের ফটক পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই পা ফেলার আর জায়গা নেই। হাজারো মানুষের ভিড় থেকে দেখা গেল ‘লালপুরীর মাজার’। ছিমছাম মাজার ভবনের পাশের মসজিদ থেকে মুসল্লিরা বের হচ্ছেন এশার নামাজ শেষে। মাজার প্রাঙ্গণ থেকে বহু দূর পর্যন্ত অস্থায়ী আস্থানাগুলোতে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত দর্শনার্থীর ভিড়।

মেলায় নাতির দাবি পূরণ করছেন দাদা

মাজারে কথা হলো নুরুল ইসলাম লালপুরীর বড় ছেলে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর সঙ্গে। তিনি বললেন, তাঁর বাবার মৃত্যু দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৯ অগ্রহায়ণ থেকে ১৬ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত সাত দিন ওরশ চলে। ওরশ উপলক্ষে বসে মেলা। হয় ওয়াজ–নসিহত, সামা ও মুর্শিদি গানের আসর। এবার শনি বা রোববার মেলা শেষ হবে।

মুঈনুদ্দীন চিশতী বলেন, ‘ওরশ মানে মিলন। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-বিভেদের ঊর্ধ্বে ওঠার প্রেমময় রূপ হলো ওরশ। এটা এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের উৎসব। গ্রামের মানুষ এই ওরশকে লালন করেন। তাঁরাই ওরশের আয়োজক, তাঁরাই ধারক। আবহমান বাংলার এই প্রেমময় রূপ চরের মানুষেরা তাঁদের হৃদয়ে জাগিয়ে রেখেছেন।’

মেলায় আসা লোকজনের জন্য খিচুরি রান্না হচ্ছে। বুধবার রাতে সোনারগাঁয়ের নুনের টেক লালপুরীর মেলায়

মেলা প্রাঙ্গণের প্রবশে মুখেই সারি সারি খাবার দোকান। দোকানগুলোতে সদ্য ভাজা পেঁয়াজু, ধোঁয়া ওঠা জিলাপি, মোয়া-মুড়কি, কদমা-বাতাসা, মুরলি, গজা মিষ্টি, মনাক্কা, নিমকি, দানাদার, তিলের খাঁজা, খই-ওখড়ার মতো শৈশবের স্মৃতি বয়ে চলা মুখরোচক সব খাবারের পসরা। আরও কিছু দূর গিয়ে দেখা গেল লম্বা দোকানে সারি সারি সাজানো শত শত টমটম, চরকি গাড়ি আর কাগজের ফুল।

এক পাশে বসে শৈশব রাঙানো এসব ঐতিহ্যবাহী খেলনা তৈরি করছেন মোহন আলী ও মো. বুলবুল। এসব শিশু খেলনা নিয়ে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থেকে প্রায় ১৫ জন মিলে মেলায় এসেছেন। বুলবুল জানালেন, অন্তত ২৭ বছর ধরে মেঘনা চরের এই মেলায় আসেন তিনি। এ বছর ভালোই কেনাবেচা হচ্ছে।

মেলায় জমেছে গানের আসর

চার বছরের নাতি হাসান মিয়াকে সঙ্গে করে মেলায় এসেছেন সোনারগাঁয়ের দরপদ গ্রামের বৃদ্ধ আসর উদ্দিন। ছোট হাসান কখনো টমটম, কখনো চরকিগাড়ি কিনে দেওয়ার বায়না ধরছে দাদার কাছে। একটি চরকিগাড়ি কিনে দিলে এবার বায়না ধরে রঙিন কাগজের ফুলের। ছেলেভোলানো নানা কথায় হাসানকে নিয়ে দোকান ছাড়েন বৃদ্ধ দাদা।

মাটির তৈরি টমটম হাতে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন চেঙ্গাকান্দী গ্রামের মো. জুয়েল। সে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। জুয়েলের ভাষ্য, যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই সে মেলায় আসেন। এই মেলা তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মৃতিময় উৎসব। মেলায় এসে শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ছে বারবার। তখন মা–বাবার কাছে কত কিছুর আবদার করত। এখন নিজেই খেলনা কিনেছে বাড়ির অন্য শিশুদের জন্য।

মেলায় বাহারি খাবারের পসরা

মেলার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত শত শত দোকান। রাত বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেলায় বাড়ে মানুষের আনাগোনা। মেলার হইহুল্লোর চাপা পড়ে যায় মাজার প্রাঙ্গণের আস্তানাগুলোতে শুরু হওয়া সামা গানের শব্দে। শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল, কাঠের নকশা, বেতের ছোট ছোট আসবাব, প্লাস্টিকের খেলনা, জামাকাপড়, গামছা, জুতা, তাবিজ, কবিরাজি ওষুধ কিংবা খাবার ঘর। মেলার সবখানেই মানুষের জটলা।
সেই জটলায় কথা হলো স্থানীয় একটি যুব সংগঠনের নেতা খাইরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, মেঘনার বুকে ভেসে ওঠা চরের ছয়টি গ্রামে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসতি। মেলাটি এই চরাঞ্চলের অন্যতম বড় উৎসব। মেলা উপলক্ষে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে অতিথি ভিড় করেন। বাড়ি ফেরেন প্রবাসীরা। তাঁর মতো যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাও আসেন চরাঞ্চলের মানুষের উৎসবে শামিল হতে।

ঘাটে ভেড়ানো অসংখ্য ট্রলার। বুধবার রাতে সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার ঘাটে

খাইরুলের কথার মিল পাওয়া গেল মেলা থেকে দূরের গ্রাম চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে। মধ্যরাতেও গ্রামের ঘরে ঘরে উৎসবের সাজ। বাড়িতে আসা অতিথিদের নিয়ে গল্প-আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন নারীরা। কথা হয় গৃহবধূ জিয়াসমিনের সঙ্গে। বললেন, তাঁরা প্রতি বছর মেলার জন্য অপেক্ষা করেন। মেলা ঘিরে গ্রামের মেয়েরা নাইওর আসেন। কাজের খোঁজে দেশ-বিদেশে যাওয়া পুরুষরাও গ্রামে ফেরেন। ঘরে ঘরে ধুম পড়ে পিঠা পায়েস আর খাবার আয়োজনের। এমনকি মেলা উপলক্ষে নতুন জামা কাপড়ও কেনাকাটা হয়।

নৌকায় করে মেলায় যাচ্ছেন লোকজন। বুধবার রাতে সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার ঘাটে

কুমিল্লার মানিকচর থেকে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা মনোয়ারা বললেন, প্রতি বছরই মেলার সময় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন তিনি। এটা একপ্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেলা উপলক্ষে পাঁচ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাড়ি ফিরেছেন শিরিষ আলী, জসিম উদ্দিন, খায়ের আলীর মতো প্রবাসীরা। মেলা শেষে আবার প্রবাসে ফিরবেন। হাবিবুর বললেন, ‘মেলায় কেউ আসেন ধর্মীয় কারণে। কেউ কেনাকাটা করতে। আমরা প্রবাসীরা আসি সব বন্ধু-স্বজনকে একসঙ্গে দেখার আশায়। এই মেলা আমাদের চরাঞ্চলের উৎসব। উৎসবে বাড়ি ফেরাই নিয়ম।’