মাদারীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে তাওহীদ সন্ন্যামাত (২১) ও রোমান বেপারী (৩২) নিহত হন। ওই রাতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁদের দাফনও হয়ে যায়। পরে এ হত্যার ঘটনায় মামলা করা হলে লাশ ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশে বৃহস্পতিবার লাশ উত্তোলনে গেলে দুই পরিবারই আপত্তি জানায়।
এ অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও লাশ উত্তোলন না করেই ফিরে আসেন জেলা প্রশাসনের দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। পরিবারের লোকজন বলেন, প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে তাঁরা মারা গেছেন। এ ঘটনায় মামলা যে হয়েছে, এটা তাঁরা জানেন না। আর মামলার বাদীকে নিয়েও তাঁদের আপত্তি আছে। তাই তাঁরা লাশ তুলতে দেবেন না।
থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে খাগদী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তাওহীদ সন্ন্যামাত ও রোমান বেপারী। ২৪ আগস্ট নিহত পিকআপচালক রোমানের স্ত্রী কাজল আক্তার বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় ৩০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। অপর দিকে ২৫ আগস্ট নিহত রাজমিস্ত্রি তাওহীদ সন্ন্যামাত হত্যার ঘটনায় জেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব কামরুল হাসান বাদী হয়ে ৭০০ জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় আরেকটি হত্যা মামলা করেন।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের সুইচারভাঙ্গা গ্রামে তাওহীদ সন্ন্যামাতের কবর থেকে লাশ উত্তোলনে আসেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাঈম সরকার। এ সময় আহাজারি আর কান্নাকাটি করে লাশ কবর থেকে উত্তোলনে আপত্তি জানান পরিবারের সদস্যরা।
তাওহীদের মা রেশমা বেগম বলেন, তাঁর ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু তাওহীদ মারা যাওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে, এটা তাঁরা জানেন না। তাই কবর থেকে লাশ ওঠাতে দেবেন না। মামলায় যদি তাঁদের বাদী করা হয়, তাহলে বিচারের জন্য লাশ ময়নাতদন্ত করতে দেওয়া হবে।
তাওহীদের ভাই আসাদ সন্ন্যামাত বলেন, ‘ভাই হারিয়েছি, এখন তো আর ভাইকে ফিরে পাব না। লাশ কবর থেকে ওঠালে পুরো পরিবারে কান্নার বন্যা হয়ে যাবে। আমরা মামলার বাদী হলে বিষয়টি ভেবে দেখতাম। আমাগো বাদ দিয়া বাদী হইছে বিএনপির লোকজন। তাই এখন কোনো অবস্থাতেই লাশ উত্তোলনের সুযোগ দেব না।’
এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাঈম সরকার বলেন, ‘তাওহীদ সন্ন্যামাতের পরিবারকে কয়েক ঘণ্টা বুঝিয়েও ব্যর্থ হয়েছি আমরা। পরে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। জেলা প্রশাসক ও আদালতের বিচারকের সিদ্ধান্তে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’
এদিকে আদালতের নির্দেশে রোমান বেপারীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলনের জন্য সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ভদ্রখোলা এলাকায় যান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম। সেখানে গিয়েও তিনি তোপের মুখে পড়েন। নিহত রোমানের স্ত্রী কাজল আক্তার মামলার বাদী হওয়ায় কোনো অবস্থাতেই লাশ উত্তোলন করতে দেবেন না বলে জানান নিহত রোমান বেপারীর মা-বাবা।
রোমানের মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের লাশ কবর থেকে ওঠাতে দেব না। আমার ছেলে মারা গেছে, তাতে আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমাদের টাকাপয়সা, কোনো কিছুই দরকার নেই।’
বাবা ওমর আলী বেপারী বলেন, এই লাশ কবর থেকে ওঠানো হলে পরিবারের অন্যরা অসুস্থ হয়ে পড়বে। কষ্টে আরেকটি দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই প্রশাসনকে অনুরোধ করবেন, তাঁরা যেন বাড়ি থেকে চলে যান।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বলেন, রোমানের পরিবারের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া লাশ কবর থেকে উত্তোলনের সুযোগ নেই। বিষয়টি আদালতে জানানো হবে। আদালতের সিদ্ধান্তের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মামলার বাদী ও রোমানের স্ত্রী কাজল আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর লাশ কবর থেকে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তুলতে দেয় নাই। এখানে আমার কোনো হাত নাই। আমি চাইলেও কিছু করতে পারছি না। তবে আমি চাই, যারা আমার স্বামীকে হত্যার জন্য দায়ী, তাঁদের বিচার হোক।’