‘ধান এবার খুব ভালোই হইছিল। আর ১৫টা দিন গেইলে ঘরোত তুলার পানু হয়। সেই ধান মোর তিন দিন থাকি পানির নিচোত। রইদোত পুড়ি, শ্যালোর পানি দিয়া আবাদ করা কষ্টের ধান চোখের সামনোত পচি নষ্ট হওছে। কিছু করার নাই।’ টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া ৫০ শতক জমির ধানখেত দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক মহুবার রহমান।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোলাপাড়া গ্রামে মহুবার রহমানের বাড়ি। মংলা ডুবের মাঠে তাঁর আউশ ধানের খেত। তাঁর পাশের খেতে ধান চাষ করেছেন দোলাপাড়া গ্রামের আরেক কৃষক মফেল উদ্দিন। তাঁরও ৬০ শতক জমির ধান এখন পানির নিচে।
মফেল উদ্দিন বলেন, ‘গরিবের মরণ চাইরো দিকে। ধার দেনা করি ধান নাগাছু। তাক বেচে ঋণ শোধ করি, বাকি টাকা দিয়া ভাঙা ঘরের টিন বদলানু হয়। কিন্তু ধান তো পানির নিচোত। পাকা না হওয়ায় কাটিরও পাওছু না। কী করিম কোনো দিশা খুঁজি পাওছু না। কপালোত যে কী আছে।’
শুধু মংলা ডুব মাঠেই নয়; রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের তেরমাইল, দোয়ালাপাড়া ও বদরগঞ্জের শাইলবাড়ি, উত্তরবাওচণ্ডীসহ নিচু ফসলি মাঠে টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে যমুনেশ্বরী ও চিকলী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানসহ ফসলি জমি পানির নিচে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। উপায় না পেয়ে অপরিপক্ব ধানই কেটে নিচ্ছেন তাঁরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, তারাগঞ্জ এবারে ৭ হাজার ৭৬০ হেক্টরে বোরো ও ১ হাজার ৬০ হেক্টরে আউশ ধানের চাষ হয়েছে। বদরগঞ্জ বোরো চাষ হয়েছে ১৬ হাজার ৭৪৫ হেক্টরে ও আউশ ৪৫৫ হেক্টরে। এ দুই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি বোরো ধান শতভাগ কাটা হয়েছে। মাঠে এখন শুধু আউশ ধান রয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ও উজানের ঢলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত নিচু এলাকার আউশ ধান তলিয়ে গেছে।
তারাগঞ্জের মংলাডুব, তেরমাইল ও দোয়ালীপাড়ার মাঠ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এসব মাঠের অধিকাংশ ধান পানির নিচে। কিছু ধান খেতে হেলে পড়েছে।
তেরমাইল মাঠে কোমরসমান পানিতে ডুবে যাওয়া ধান কাটছিলেন জগদীশপুর গ্রামের কৃষক এয়াকুব আলী। আক্ষেপ করে এয়াকুব আলী বলেন, ‘ধানকোনা আরও এক সপ্তাহ গেলো হয়। উপায় না পায়া আধা পাকা ধান কাটুছু। বেশি দামেও কৃষাণ পাওয়া যাওছে না। ওই জন্যে নিজে পানিত নামি কাটুছু। নাইলে যে একনা ধানও পাইম না।’
ওই মাঠে কথা হয় আরেক কৃষক বালাপাড়া গ্রামের শাহাজাহান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ৯০ শতক জমির সব ধান তাঁর পানির নিচে। আর দুই দিন থাকলে ধান পচে গন্ধ বের হবে। পানিতে ডুবে যাওয়ায় তাঁর ৫০ হাজার টাকার লোকসান হবে। এ ছাড়াও এ মাঠের বাবু মিয়ার ৭০ শতক, একরামুল হকের ২ একর জমির ধান পানির নিচে বলে জানান তাঁরা।
১০ কাঠাত ধান দেরি করি নাগাছি, দেরিতে পাকছে। হঠাৎ পানি হয়া সেই ধান তলে গেইছে। এ্যালা বুজিক ধানটা আর পাওয়া যাবার নেয়।পরেশ চন্দ্র রায়, বদরগঞ্জের উত্তরবাওচণ্ডী গ্রামের বাসিন্দা
এদিকে বদরগঞ্জে ধান কাটা ও মাড়াই প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে দেরিতে লাগানো কিছু ধান মাঠ থেকে এখনো কাটতে পারেননি কৃষকেরা। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ধানখেত ডুবে যাওয়ায় কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। বদরগঞ্জের উত্তরবাওচণ্ডী গ্রামের পরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘অতি বৃষ্টিতে আমার ৫৫ শতক জমির পাকা ধানখেতে পানি জমেছে। তাই কেটে ঘরে তুলতে পারছি না।’
বদরগঞ্জের শাইলবাড়ি গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘১০ কাঠাত ধান দেরি করি নাগাছি, দেরিতে পাকছে। হঠাৎ পানি হয়া সেই ধান তলে গেইছে। এ্যালা বুজিক ধানটা আর পাওয়া যাবার নেয়।’ ওই গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ ও মহুবার রহমানেরও পাকা ধানখেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, এখন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে পাকা ধান বেশি দিন তলিয়ে থাকলে নষ্ট হতে পারে। তবে ধানখেত তলিয়ে থাকার কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
তারাগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা ধীবা রানী রায় বলেন, ‘আউশের যেসব মাঠ ডুবে গেছে, সেগুলো সরেজমিন দেখেছি। আগামী রোববার পর্যন্ত যদি ডুবে যাওয়া খেত থেকে পানি না নামে, তাহলে কিছুটা ক্ষতি হতে পারে।’