সেতু-কালভার্টের অপরিকল্পিত দৈর্ঘ্য সংকুচিত করেছে নদ-নদীকে। স্রোত হারিয়েছে। সংকুচিত নদে খননের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
যশোরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ১৫টি নদ-নদী। দখল ও দূষণ এবং অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্টে এখন ভৈরবের মতো সব কটি নদ-নদী অস্তিত্বসংকটে। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই অবৈধ দখলদারদের তালিকা নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এই তালিকায় জেলার ৬৭৩ জন অবৈধ দখলদারের নাম ছিল। গত বছর ওই তালিকা ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
মৃতপ্রায় এসব নদ-নদীকে বাঁচাতে নানা সময়ে খননসহ নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু সেসব খুব একটা কাজে আসেনি। অন্যদিকে পরিকল্পনার সমন্বয়হীনতায় নদ-নদীর ওপরে তৈরি করা হয়েছে ছোট–বড় সেতু-কালভার্ট। বর্তমানেও সেতু-কালভার্ট নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। এসব সেতু-কালভার্টের অপরিকল্পিত দৈর্ঘ্য সংকুচিত করেছে নদ-নদীকে। স্রোত হারিয়েছে নদ-নদী।
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা। এখানে ভৈরব নদের ওপর রয়েছে দড়াটানা সেতু। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে মনে হবে যেন একটি সরু খাল বয়ে গেছে। সেতুর দুই দিকে প্লাবনভূমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। এসব স্থাপনার বর্জ্য ঢালা হচ্ছে নদে। নদের পানি কুচকুচে কালো। ভৈরব অর্থ ‘রুদ্রমূর্তি’। ভৈরবের এখন আর রুদ্রমূর্তি নেই। দখল-দূষণ আর অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্টে ধুঁকতে ধুঁকতে কোনো রকমে বয়ে চলেছে ভৈরব।
দড়াটানা সেতু থেকে কাঠের পুল পর্যন্ত ভৈরব নদের ৮০০ মিটারের দুই তীরে অন্তত ২০টি বহুতল ভবনসহ ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী দখলদার রয়েছে। নদের প্লাবনভূমিতে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। নদের এই অংশের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেনি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অথচ নদের ওই অংশ বাদ রেখে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পশ্চিমাংশের ৮৪টি স্থাপনা এবং পূর্বাংশের সাড়ে তিন কিলোমিটারে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। নদের তীরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনার মেডিকেল বর্জ্য ও ভবনের শৌচাগারের মানববর্জ্য সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভৈরব নদে ফেলা হচ্ছে। এতে নদের পানি কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানি দুর্গন্ধযুক্ত।
কপোতাক্ষের দৈর্ঘ্য ১৮০ কিলোমিটার। বিআইডব্লিউটিএর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নদে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ২১টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সেতুর উচ্চতাই কম। সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে নদটিকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। কপোতাক্ষ নদের পানিপ্রবাহে গতি এনে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে নদটি খনন করছে পাউবো। কিন্তু সংকুচিত নদে খননের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ভৈরব নদের অবৈধ দখলদারের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তা অসম্পূর্ণ। প্রকৃত অবৈধ দখলদারের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। পরে তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়। নদীর ওপর অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ করে উন্নয়নের নামে নদী মেরে ফেলা হচ্ছে।ইকবাল কবির জাহিদ, উপদেষ্ট, ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটি
বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। আংশিক তালিকায় এই নদীর ওপর ৪১ জন অবৈধ দখলদার রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানো হয়, তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া আংশিক তালিকায় মনিরামপুর উপজেলার হরিহর নদ এবং মুক্তেশ্বরী, শ্রী ও হরি নদী দখল করেছেন ১৬২ জন, ঝিকরগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদীর দুই পাশ দখল করে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন ৩০ জন, চৌগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদ দখল করেছেন ৮০ জন এবং শার্শা উপজেলার বেতনা নদী ও হাকর নদী দখল করেছেন ২২৪ জন। আর অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের ৪৯ জন দখলদারের নাম তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে হরিহর নদের ওপর দুটি, মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর দুটি, টেকা নদীর ওপর একটি, চিত্রা নদীর ওপর একটি এবং শ্রী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সব কটি সেতুর উচ্চতা কম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাউবো যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, নদের ওপর তৈরি সংকীর্ণ সেতু-কালভার্ট নদের প্রাণ ফেরার পথে বাধা। ভৈরব নদের ওপর নির্মিত নাতিদীর্ঘ ৫১টি সেতু ও কালভার্ট অপসারণ করে নদীর প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের জন্য নির্মাণকারী ছয়টি দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিন কোটি টাকা ব্যয়ে কোদলা নদীর সাড়ে চার কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ নদের ৭৯ কিলোমিটার খননকাজ চলমান। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হাকর নদীর পাঁচ কিলোমিটার খননকাজ দ্রুত শুরু হয়েছে। ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চিত্রা নদীর ৩৮ কিলোমিটারের খনন শুরু হবে। খননকাজ শেষ হলে নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবে।
আজ ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। ১৯৯৭ সালে ব্রাজিলে কুরিতিবা শহরে এক সমাবেশ থেকে নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নদীকৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে এ দিবস। এখন যশোরের নদীগুলোর গলার কাঁটা অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্টগুলো সরানোর দায় কার—এ প্রশ্ন নদীবিষয়ক আন্দোলনকর্মীদের।
ভৈরব নদের নাতিদীর্ঘ সেতু-কালভার্টগুলো নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর—এই ছয়টি দপ্তর। তাদের এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে পাউবো।
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ভৈরব নদের অবৈধ দখলদারের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তা অসম্পূর্ণ। প্রকৃত অবৈধ দখলদারের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। পরে তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়। এসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। দূষণ বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। নদীর ওপর অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ করে উন্নয়নের নামে নদী মেরে ফেলা হচ্ছে।
জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভৈরব নদের বেশির ভাগ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। একটি বাকি আছে। সেটাও দ্রুত উচ্ছেদ করা হবে। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে জেলার অন্যান্য নদ-নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘যশোর শহরে ভৈরবের দূষণকারী ১০২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। নদ-নদীর ওপর সংকীর্ণ সেতু অপসারণ এবং নদীর প্রশস্ততা অনুযায়ী নির্মাণের জন্য সর্বশেষ জেলা সমন্বয় কমিটির মিটিংয়ে এলজিইডিকে বলা হয়েছে।’