নারায়ণগঞ্জ

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ব্যবসা, নজর নেই রাজউকের 

যত দিন যাচ্ছে ততই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে জরাজীর্ণ ভবনগুলো। প্রতিদিনই প্রাণভয় নিয়ে গদি খুলতে হয় ব্যবসায়ীদের।

নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের ওল্ড ব্যাংক রোডে পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো বিভিন্ন পণ্যের গুদামঘর ও গদি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা
ছবি: দিনার মাহমুদ

চুন, সুরকি ও ইট দিয়ে নির্মিত একেকটি ভবন শত বছরের বেশি পুরোনো। ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভবন ধসের ঘটনায় যেকোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণহানি। ঝুঁকিপূর্ণ এমন অর্ধশতাধিক ভবনে চলছে নিত্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসা। ব্যবসাকেন্দ্রটি শহরের নিতাইগঞ্জের আর কে দাস রোড, বি দাস রোড, ওল্ড ব্যাংক রোড ও শহরের টানবাজারে। ভবনগুলোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। 

গত শনিবার আর কে দাস রোডের ইলিয়াছ দেওয়ানের মালিকানাধীন পুরোনো একটি দোতলা ভবনে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৯ জন। বিস্ফোরণে ভবনের তিনটি গদিঘর, বারান্দার ছাদ ও পেছনের অংশ ধসে পড়ে। ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী বলছে ফায়ার সার্ভিস। এই ঘটনার আগেও এই ভবনে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু হয়েছিল।

সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় ওই ভবন ১৫ নম্বরে। ভবনমালিক ইলিয়াছ দেওয়ানের চাচাতো ভাই সালাউদ্দিন দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ভবন ভেঙে ফেলতে নোটিশ দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। রাজউক নতুন ভবনের অনুমতি না দেওয়ায় পুরোনো ভবনটি চাইলেও ভাঙতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০০ বছর আগে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নিতাইগঞ্জে নগরী গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এখানে ব্যবসাবাণিজ্য গড়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারেরা এখান থেকে পণ্য কিনে নিয়ে যান। ৩০ থেকে ৪০টি জেলায় এখান থেকে নিত্য পণ্য সরবরাহ হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, নিতাইগঞ্জে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। অধিকাংশ ব্যবসায়ী গদি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা চালান। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে জরাজীর্ণ ভবনগুলো। ফলে প্রাণভয় নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে তাঁদের।

৩০ বছর ধরে নিতাইগঞ্জের ওল্ড ব্যাংক রোডে নারায়ণগঞ্জ সল্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজের গদিঘরের ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করছেন বিপ্লব সরকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এখানে কাজ করতে এসে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা গরিব ও সাধারণ কর্মচারী। ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁদের কোনো নিরাপত্তা নেই।

ওই রোডের ঝুঁকিপূর্ণ একটি ভবনের অংশীদার দিলীপ রায়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা জটিলতার কারণে পুরোনো ভবন ভাঙতে পারছি না। এখানে অনেক পুরোনো ভবন আছে, আপনারা চাইলে ভেঙে দেন, আমরা চলে যাব।’

২০১৬ সালের ১১ অক্টোবর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে তা ভেঙে ফেলতে স্থানীয় পত্রিকায় জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। কিন্তু ভবনমালিকেরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। একই সঙ্গে ভবনগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চিঠি দেওয়া হলেও সরকারি সংস্থাগুলো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ওয়ার্ডে নিতাইগঞ্জ ও টানবাজারে ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। ভবনমালিকদের চিঠি দেওয়া হলেও তাঁরা অপসারণে উদ্যোগ নেননি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বড় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

পুরোনো ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে স্বীকার করেছেন নিতাইগঞ্জ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শংকর সাহা। তাঁর ভাষ্য, ঝুঁকিপূর্ণ পুরোনো ভবনগুলো লাল নিশানা টাঙিয়ে চিহ্নিত করতে হবে, সেগুলো অপসারণে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

সিটি করপোরেশন এলাকায় ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। সাত বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভাঙতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভবনমালিকদেরও চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা ভাঙতে উদ্যোগ নেননি। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চিঠি দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাজউককে আবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজউক জোন-৮ অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহ্ ইয়া খান প্রথম আলোকে বলেন, গত সপ্তাহে নিতাইগঞ্জসহ জেলার ঝুঁকিপূর্ণ ১১৪টি ভবন চিহ্নিত করে সেই তালিকা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার বিষয়ে রাজউক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায় রাজউক এড়াতে পারে না। দ্রুত পুরোনো ভবন ভেঙে ফেলতে রাজউককে উদ্যোগ নিতে হবে।