এক বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৩৫টি দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হয়নি।
জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত আটটি স্থান ‘বাস স্টপেজে’ পরিণত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে গত এক বছরে ১৩৫টি দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছেন। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মোটরসাইকেলের অনিয়মতান্ত্রিক চলাচল ও পদচারী–সেতু ব্যবহার না করে পথচারী পারাপারের কারণে এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
এদিকে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। এই মহাসড়কে বড় বড় দুর্ঘটনার পর একেকটি তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কটির দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার।
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অনেক পথচারীও আছেন। পথচারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে পদচারী–সেতু। কিন্তু বেশির ভাগই তা ব্যবহার করেন না।
মাদারীপুর ও গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের হিসাব বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৩৫টি দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা–মাওয়া অংশে ৭২টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৪ জন; আহত হয়েছেন ৭৮ জন, মামলা হয়েছে ৫৭টি এবং জিডি ১৫টি। জাজিরা–ভাঙ্গা অংশে ৬৩টি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নিহত ও ৯৪ জন আহত হয়েছেন; মামলা হয়েছে ৫৭টি এবং জিডি ১৫টি।
বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা রোধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত কেন হলো না, বিষয়টি আমি দেখব এবং যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য জোর দেব। যারা এক্সপ্রেসওয়েতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন, নিয়ম মানবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান
সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি
এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হয়নি। এক্সপ্রেসওয়েতে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ১৯ মার্চ। মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় মহাসড়কের রেলিং ভেঙে পড়ে যায় যাত্রীবাহী বাস। এতে ১৯ জন নিহত হন। ওই দুর্ঘটনার পর মাদারীপুর জেলা প্রশাসক দুর্ঘটনার কারণ ও দুর্ঘটনা রোধে কী করণীয়, সে সম্পর্কে জানতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
ওই কমিটি এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা রোধের জন্য ১৪টি সুপারিশ করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চালকের লাইসেন্স ও গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নিয়ে মহাসড়কে গাড়ি চালানো, দ্রুতগতির গাড়ির যাত্রীদের সিটবেল্ট পরা, নির্মিতব্য এক্সপ্রেসওয়েতে একমুখী রাস্তায় কমপক্ষে তিন লেনের ব্যবস্থা রাখা ও উভয় মুখে কমপক্ষে ছয় লেনের ব্যবস্থা করা, মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়ির সব হালনাগাদ তথ্য একটি সমন্বিত ডেটাবেজে রেখে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গতিসীমা কমিয়ে গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রভৃতি।
এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা রোধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত কেন হলো না, বিষয়টি আমি দেখব এবং যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য জোর দেব। যারা এক্সপ্রেসওয়েতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন, নিয়ম মানবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারা দেশে সব যানবাহনে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এমরান খান
গত বছরের ২৪ জুন এক্সপ্রেসওয়ের মালিগ্রামে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স সড়ক বিভাজকে ধাক্কা দিলে তাতে আগুন ধরে যায় এবং পুড়ে মারা যান সাতজন। এ ঘটনায় ফরিদপুর জেলা প্রশাসন ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুদিন পর ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা রোধে ছয়টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—এক্সপ্রেসওয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গতিনিয়ন্ত্রক ক্যামেরা স্থাপন, হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি এবং বিআরটিএর মাধ্যমে সারা দেশে সব যানবাহনে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া।
এ বিষয়ে ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এমরান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে সব যানবাহনে গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানোর যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।’
যত্রতত্র ‘বাস স্টপেজ’
এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি থামানোর জন্য নির্ধারিত জায়গা আছে। কিন্তু অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নামানো ও ওঠানো হচ্ছে। জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটারে অন্তত আটটি স্থান ‘বাস স্টপেজে’ পরিণত হয়েছে। গত বুধবার গিয়ে দেখা যায়, রমনাকান্দা, সূর্যনগর, পাঁচ্চর ও নাওডোবা এলাকায় বাসে যাত্রী তোলা ও নামানো হচ্ছে। পাঁচ্চর গোলচত্বর ও ভাঙ্গা টোল প্লাজার আগে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাস ৫–১০ মিনিট থেকে থাকছে। এখানে দূরপাল্লার অনেক বাসের অস্থায়ী কাউন্টারও রয়েছে। এসব কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে যাত্রীরা বাসে উঠছেন। এ ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাক ও মাইক্রোবাস থেমে আছে।
এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের মধ্যে অনেক পথচারীও রয়েছেন। পথচারীদের পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে পদচারী–সেতু। কিন্তু বেশির ভাগ পথচারী সেই সেতু ব্যবহার করেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে কিংবা দৌড়ে সড়ক পার হন। তখন তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন।
এক্সপ্রেসওয়েতে নির্ধারিত গতিতে যানবাহন চালানোর জন্য নির্দেশনা রয়েছে। সড়কের ওপর নির্ধারিত গতিবেগ লেখা আছে। তবে ওই নির্দেশনা না মেনে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর অভিযোগ রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে। শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের চালক সোলেমন মিয়া বলেন, ‘আমাদের বাসের গতি ১০০–এর (প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার) মধ্যে ওঠানামা করে। এখানে গতি কোনো ব্যাপার না। সড়কের যেখানে–সেখানে পার্কিং, যাত্রী ওঠানো–নামানোর মতো বিশৃঙ্খলা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি।’
সার্বিক বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহীনূর আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্পিড কন্ট্রোল ক্যামেরা বসানোর সুপারিশটি আমরা কার্যকর করতে পারিনি। এ রকম একটি পাইলট প্রকল্প চট্টগ্রাম হাইওয়েতে চলমান রয়েছে। ওই প্রকল্পের সাফল্যর ভিত্তিতে এই হাইওয়েতে তা কার্যকর করা হবে।’