ভূমির বর্তমান অবস্থাসহ নানা তথ্য নিজের কম্পিউটারের মনিটরের পর্দায় দেখাচ্ছেন সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার(ভূমি) মো. আলাউদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে
ভূমির বর্তমান অবস্থাসহ নানা তথ্য নিজের কম্পিউটারের মনিটরের পর্দায় দেখাচ্ছেন সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার(ভূমি) মো. আলাউদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে

এক ক্লিকেই মিলছে ভূমির সব তথ্য

মৌজা ও দাগ নম্বর লিখে ক্লিক করলেই সামনে ভেসে উঠবে জায়গাটি কোথায়, বর্তমান অবস্থা কী, মামলা রয়েছে কি না, সরকারি সম্পত্তি কি না—এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি তথ্য। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি কার্যালয় এবং চারটি তহসিল কার্যালয়ের জন্য এমনই এক সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। এতে উপজেলার ভূমিবিষয়ক বিভিন্ন জটিলতার প্রাথমিক সমাধানের জন্য মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ছে না ভূমি কর্মকর্তাদের।

সমন্বিত স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা নামে এই সিস্টেম নির্মাণ করেছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলাউদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) এলাকায় প্রতিষ্ঠানের ভূমিসংক্রান্ত জটিলতার বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপক (ট্রান্সমিশন) এফ এম তাহজিবুল হাসিম। তিনি ওই ভূমির দাগ ও মৌজা নম্বর বলার পরমুহূর্তেই কম্পিউটার থেকে ওই ভূমির স্যাটেলাইট ইমেজ বের করে দেখান সহকারী কমিশনার আলাউদ্দিন। বিটিসিএল কর্মকর্তা ভূমির কোন অংশ বেদখল হয়েছে, তা বলামাত্র পুরোনো স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে বেদখলের সাল-তারিখ চিহ্নিত করে দেন। পরে বিটিসিএল কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।

কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর বিটিসিএল কর্মকর্তা এফ এম তাহজিবুল হাসিমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের পর সেটি নামজারি করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে করণীয় বিষয়ে জানতে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন, প্রয়োজনীয় কিছু নথি সংগ্রহের জন্য আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে হবে, কিন্তু সহকারী কমিশনার তাঁদের তৈরি করা সিস্টেম থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই মুহূর্তের মধ্যে দিয়েছেন। সহজে সব সেবা পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আগে ভূমিসংক্রান্ত অনেক সমস্যায় মামলা হলে রেকর্ড অব রাইটস (আরওআর) এবং নকশা ও রেজিস্ট্রারের সমন্বয় করে তথ্য জানতে হতো। এটি জটিল প্রক্রিয়া। সমস্যা সমাধানে অনেক বেগ পেতে হয়। এ ছাড়া বিবদমান ভূমিতে দফায় দফায় সার্ভেয়ার, তহসিলদার পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে। যার কারণে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। এখন সমন্বিত স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের কারণে অনেক জটিল সমস্যার প্রাথমিক সমাধান মুহূর্তেই হচ্ছে।

স্যাটেলাইট ইমেজের সঙ্গে আরএস ও বিএস নকশার দাগের সমন্বয়ে ডিজিটাল চিত্র তৈরি হয়েছে। এ চিত্রে ভিন্ন রঙ দিয়ে সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি চিহ্নিত করা হয়েছে

মো. আলাউদ্দিন আরও বলেন, ভূমি কার্যালয়ে এসেই অনেকে বলেন, তাঁর জায়গা অন্যজন নিজের মালিকানা দাবি করে দখল করেছেন কিংবা আরেকজনের নামে জরিপ হয়ে গেছে। এ ছাড়া সরকারি সম্পত্তি দখল করে কিংবা শ্রেণি পরিবর্তন করে স্থাপনা নির্মাণ করেন ভূমিদস্যুরা। তাঁদের তলব করলে দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে অকাট্য যুক্তি দেন। তখন মুহূর্তেই সিস্টেমে ঢুকে মিথ্যা তথ্য শনাক্ত করা যায়।

উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে মোট ৬৬টি মৌজায় বিএস জরিপে ১ লাখ ৭১ হাজার ১৮৮টি দাগ রয়েছে। এ রকম বিভিন্ন জরিপে আলাদা দাগ নম্বর রয়েছে। প্রিন্ট করা কাগজে একটি জরিপের নকশার দাগ ও অন্য জরিপে তা কোন দাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা বের করা সনাতন পদ্ধতিতে একটি জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে বের করা অনেক সহজ।

২০১৬ সালে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে পাস করেন মো. আলাউদ্দিন। চাকরিজীবনের শুরুতে পেট্রোবাংলার গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) প্ল্যানিং বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। পরে ৩৭তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে। ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে তাঁকে পদায়ন করা হয়। এরপর গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সীতাকুণ্ডে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

সীতাকুণ্ড ভূমি কার্যালয়ের স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনার ড্যাশ বোর্ড

সমন্বিত স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের কথা কীভাবে মাথায় এল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোয়ালখালীতে পদায়নের পর সেবাগ্রহীতাদের ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা সমাধানে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। তখন মাথায় চিন্তা আসে একাধিক জরিপের নকশার দাগ ও গুগল ইমেজ যদি সমন্বয় করা যায়, তাহলে ক্লিকেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জিটিসিএলে কাজ করার সময় ভূমি জরিপের জিওরেফারেন্সিং শিখেছিলেন। সেই শিখনকে কাজে লাগিয়ে তিনি পদায়নের চার মাসের মাথায় প্রথম বোয়ালখালীতে এই সিস্টেম তৈরি করেন। সীতাকুণ্ডে আসার পরও একই কাজ করেছেন।

মো. আলাউদ্দিনের এই সিস্টেম ভূমি মন্ত্রণালয়ের ইনোভেশন শোকেসিং ২০২২-২৩-এ মাঠপর্যায়ে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন বলে জানান সহকারী কমিশনার মো. আলাউদ্দিন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ভূমি সংস্কার বোর্ডের সেরা উদ্ভাবনী উদ্যোগেও প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, বোয়ালখালীর মতো সীতাকুণ্ডেও সমন্বিত স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য তিনি সহকারী কমিশনার আলাউদ্দিনকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এই সিস্টেমে মুহূর্তের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।