সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শহরের অনেক বাড়িঘর, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে শহরের কাজীর পয়েন্ট এলাকায়
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শহরের অনেক বাড়িঘর, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে শহরের কাজীর পয়েন্ট এলাকায়

‘মনে তো ২২ সালের সেই ভয়ংকর বন্যা, তাই ভয়টা বেশি’

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বেশির ভাগ সড়কই এখন বন্যার পানিতে প্লাবিত। কোনো কোনো সড়কে সুরমা নদীর পানির স্রোত বইছে। বন্যার পানি ঢুকেছে মানুষের ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মানুষের বসতঘরে পানি ঢোকায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার কেউ কেউ যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। শহরের কবি মমিনুল মউজদীন সড়কের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমরার মনে তো ’২২ সালের সেই ভয়ংকর বন্যা, তাই ভয় বেশি। মানুষের মাঝে সেই আতঙ্কটাই কাজ করছে।’

শহর ঘুরে বন্যা পরিস্থিতি দেখেছেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাদিক, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কেন্দ্র বলা হয় আলফাত স্কয়ারকে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে একটি সড়ক গেছে উকিলপাড়া, কাজীর পয়েন্ট, ষোলঘর হয়ে একেবারে পৌর শহরে শেষ প্রাপ্ত নবীনগর এলাকা পর্যন্ত। এই সড়কের উকিলপাড়া থেকে শুরু করে নবীনগর পর্যন্ত বন্যার পানি। কোথায় হাঁটু, কোথাওবা তার চেয়ে বেশি। কোথাও কোথাও পানির স্রোত বেশি থাকায় সেখানে নৌকায় যাতায়াত করেছেন লোকজন।

কাজীর পয়েন্ট এলাকার ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, শহরের সড়কগুলোর মধ্যে এখানে পানি বেশি। দোকানপাটে পানি ঢোকায় সেগুলো বন্ধ। রাত থেকে পানি বেশি বেড়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের বাসভবন প্রাঙ্গণও বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে শহরের ডি এস রোড এলাকায়

একইভাবে শহরের ষোলঘর, নবীনগর, বড়পাড়া, মল্লিকপুর, ওয়েজখালী, ফিরোজপুর, উকিলপাড়া, মুক্তারপাড়া, হাজীপাড়া, আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, নতুনপাড়া, কালীপুর সমবায় সুপার মার্কেট, মধ্যবাজার, পশ্চিমবাজার এলাকাতেও বন্যার পানি আছে। এসব এলাকায় অনেক দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকছে। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ও মানুষের বাসাবাড়িতে পানি দেখা গেছে।

শহরের ডি এস রোডে জেলা প্রশাসকের বাসভবন প্রাঙ্গণ, ষোলঘর এলাকায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন প্রাঙ্গণে হাঁটুসমান পানি দেখা যায়। একইভাবে প্লাবিত হয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়।

ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা বিন্দু তালুকদার বলেন, বৃষ্টি হচ্ছে কয়েক দিন থেকেই। কিন্তু গতকাল সোমবার রাত থেকে সুরমা নদীর তীর উপচে শহরে পানি ঢুকতে থাকে। আজ দুপুরের মধ্যে বিভিন্ন সড়ক ও অনেক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। একই এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক মমিন মিয়া বলেন, এলাকায় যে বসতিতে থাকতেন, সেখানে এখন হাঁটুপানি। তার সঙ্গে আরও তিন থেকে চারটি পরিবার আছে। এখন কোথায় আশ্রয় নেবেন, সেই চিন্তা করছেন।

পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ ইয়াসিনুর রশিদকে পাওয়া গেল ষোলঘর এলাকায়। তিনি বলেন, সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল খুলে দেওয়া হচ্ছে মানুষ আশ্রয় নেওয়ার জন্য।

হাসননগর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী জমিরুল হক বলেন, ‘সোমবার রাত থেকে ঘরে পানি। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় উঠব—এ নিয়ে চিন্তায় আছি। আশ্রয়কেন্দ্রে যাব—এ কথা পরিবারের অন্যদের সাহস করে বলতেও পারছি না।’

শহরের তেঘরিয়া এলাকায় গিয়েও রাস্তাঘাট ও মানুষের বসতঘরে পানি দেখা গেছে। এই এলাকার কাউন্সিলর আহসান জামিল বলেছেন, অনেক ঘরবাড়িতে পানি। ভোর থেকে লোকজনকে এলাকার স্কুল ও মাদ্রাসায় নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে আছে।

শহরের মধ্যবাজার এলাকার ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম বলেন, এটি শহরের উল্লেখযোগ্য ব্যবসাকেন্দ্র। অনেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। এতে সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পানি বাড়লে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি আরও বাড়বে। আরেক ব্যবসায়ী লিটন রায় বলেন, আজ সকাল থেকে পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। এরপর পানি দোকানে ঢুকে। কোনো জিনিস সরাতে পারেননি, সব নষ্ট হয়ে গেছে।

সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির গতকাল রাত থেকে অবনতি হয়েছে। আজ ভোর থেকে হু হু করে পানি বাড়ছে। সকালে তিন ঘণ্টায় (৬টা-৯টা) সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ২৭ সেন্টিমিটার। নয়টায় এখানে পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। ছাতক উপজেলা সদরে সুরমা নদীর পানি ১৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা) বৃষ্টি হয়েছে ৬৭ মিলিমিটার। তবে এখানে বৃষ্টি কম হলেও সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এ সময় ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে, ৩৯৫ মিলিমিটার। যে কারণে উজান থেকে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামছে।

জেলার ছাতক, সদর, বিশ্বম্ভরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ছাতক-সিলেট সড়ক, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর সড়ক প্লাবিত হওয়ায় এসব সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার দুপুরে বলেন, সুনামগঞ্জে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী ও অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তাই পানি আরও বাড়বে। যদি উজানে বেশি বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রয়োজনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।