দূর থেকেই দেখা যায় পাড়ে (বাঁধ) দু-একটি টিনের ঘর দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের কাছেই নদের খাড়া পাড় ওপর থেকে নিচে নেমে গেছে। আর কিছুটা ভাঙলেই ঘরটি কাত হয়ে ঢলে পড়বে নদের গর্ভে। এই পাড় ও পাড়সংলগ্ন স্থানে এ রকম ১০-১৫টি ঘর আছে। ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যেই পাড় ঘেঁষে ঘরগুলো পাশাপাশি দাঁড়ানো।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রামে ধলাই নদের পাড়ের এই স্থানে এ রকম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ২২টি রবিদাস সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবারের বসবাস। ধলাই নদের ভাঙনে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি কবেই নদের গর্ভে তলিয়ে গেছে, ঠাঁই হয়েছে অপর পাড়ে। এখানেও স্বস্তি নেই। প্রায় ১৫ বছর ধরে তাঁদের আশ্রয়ের এই কূলটিও ভেঙে চলেছে ধলাই। মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে যাওয়ার পথে।
সম্প্রতি উবাহাটা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ধলাই নদের পাড় ঘেঁষে শান্ত, কোলাহলহীন একটি এলাকা। স্থির, ধীরে বইছে ধলাই নদের জল। নদটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই, মাত্র কটা দিন আগেও কী উত্তাল, হিংস্র থাবায় কাঁপিয়েছে দুই পাড়। কোথাও পাড় ভেঙে গ্রামের ভেতরে হু হু করে ঢুকেছে পানি। তলিয়ে গেছে ফসল, রাস্তাঘাট, মানুষের ঘরবাড়ি। এখনো পাড় ভাঙনাতঙ্কমুক্ত নয় স্থানটি। ধলাই নদের পাড়, পাড় ঘেঁষে বেশ কয়েকটি ঘর। একটি ঘর তো প্রায় ঝুলে আছে নদের কাছে। পাড়ের মাটি আরেকটু ধসে গেলে ঘরটিও কাত হয়ে পড়ে যাবে। নদের বুকে তলিয়ে যাবে। এ অবস্থাতেই পাড়ের ওপর ঝুঁকি নিয়ে দুজন নারী কাজ করছেন। ভাঙনের সঙ্গে তাঁদের প্রতিদিনের জীবন এ রকমই মিলেমিশে আছে।
এই জায়গার বাসিন্দা বাদল রবিদাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০–১৫ বছর ধরে ধলাই এদিকে (তাঁদের বসতির দিকে) ভাঙতে আছে। দেখেন, একটা ঘর বাঁধের মধ্যে একবারে ঝুলে আছে। যেকোনো সময় নদীতে (নদে) চলে যেতে পারে।’ কানাইলাল রবিদাস বলেন, ‘সব ছাড়াই নিছে (ভেঙে ফেলেছে)। একজন একটু জায়গা দিছে। একচালা ঘর করে খুব কষ্ট করে আছি।’
রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকজন জানিয়েছেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে উবাহাটা গ্রামে তাঁরা বসবাস করে আসছেন। সে অনেককাল আগের কথা। তখন তাঁরা বাস করতেন, এখন যেখানে আছেন তার ঠিক উল্টো দিকে, ধলাই নদের পূর্ব পাশে। কিন্তু ধলাই নদের ভাঙনে তাঁদের পূর্বপুরুষের সেই ভিটাগুলো নদের গর্ভে তলিয়ে গেছে। একসময় নদটির পশ্চিম পাশে এসে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা নদের পাড় ঘেঁষেই ঘরবাড়ি করে আশ্রয় নেন। জুতা সেলাই তাঁদের অন্যতম প্রধান পেশা। শহর বা গ্রামের হাটবাজারে জুতা সেলাই করেই অনেকের জীবন-জীবিকা চলে গেছে। কিন্তু এখন নানা রকম জুতার রমরমার এই সময়ে তাঁদের সেই পেশাটি আর আগের অবস্থায় নেই। এসব করে আর পেট চলে না। তাঁদের কারও ভাষায় ‘রবাট’ অর্থাৎ রাবার বের হয়ে তাঁদের পেশাকে বিপন্ন করেছে। অনেকে কৃষিকাজ করেন, তা–ও বন্যা-দুর্যোগে পড়ে টিকে থাকা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। এদিকে স্থান বদল করে পশ্চিম পাড়ে এসেও তাঁরা স্বস্তিতে নেই। এখানেও নদের ভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। একে একে অনেকের ঘরবাড়ি ধলাই নদের বুকে তলিয়ে গেছে। এবারের বর্ষায়ও রাজকুমার রবিদাসের দুটি, সুনীল রবিদাসের একটি ও মিঠাইলাল রবিদাসের একটি ঘর নদের বুকে ভেঙে পড়েছে। এখন ভাঙতে ভাঙতে যেখানে এসে বাঁধ ঠেকেছে, এরপর ভাঙলে আর তাঁদের এখানে টিকে থাকার এক টুকরা জমিও থাকবে না। পাশে অন্যদের ব্যক্তিগত জমিজমা। মূল স্রোতোধারার বাইরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই ২২টি পরিবার অন্য কোথাও গিয়ে নিজেদের উদ্যোগে নতুন করে ঘর বাঁধবে, সেই সুযোগ-সামর্থ্য তাদের নেই।
জালিম রবিদাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘একচালার মধ্যে কী কষ্টে আছি, ভাঙাচুরা ঘর। কেউ বুঝব না।’ মইনি রবিদাস জানান, ‘এবার ঘরে পানি উঠছে। উঠান পানিতে তলিয়েছিল। কেউ কিছু খেত (ধান চাষ) করে। এবার বন্যায় তাঁদের খেত নিয়ে গেছে।’
স্থানীয় মানুষের সমস্যা, সংকট, সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেন লোকগবেষক ও সংগঠক আহমদ সিরাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শত বছর আগে থেকে কমলগঞ্জের মুন্সীবাজার ইউনিয়নের উবাহাটায় রবিদাস জনগোষ্ঠী নিজস্ব ভিটাজমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিল। ধলাই নদের ভাঙনে ২২টি পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। নদীর অন্য পাড়ে আশ্রয় নিলেও এখানেও ভাঙনের আঘাত থেকে তারা রক্ষা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেকটা মূল¯স্রোতের বাইরে এই ২২টি বিপন্ন রবিদাস পরিবারের পুনর্বাসন জরুরি। তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি এখনো আবেদন-নিবেদন ও আশ্বাসের মধ্যেই আটকে আছে। জরুরিভিত্তিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়নাল আবেদীন গত সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা বা উদ্যোগ নেই।