সাতক্ষীরার তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের এক শিশু কাকুলি সরকার (৯)। অজপাড়াগাঁয়ের এই শিশুর সঙ্গে সখ্য ইতালির ৩২ বছরের যুবক আন্দ্রেয়া ডেলসোলভাটোরের। চিঠি আর ছবি আদান-প্রদানের মাধ্যমে ছোট্ট এই শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আন্দ্রেয়ার। ছোট হাতে লেখা চিঠিতে কাকুলি তাঁর গ্রাম দেখার জন্য আন্দ্রেয়াকে আমন্ত্রণ জনিয়েছিল। কাকুলির আবদার ফেলতে পারেননি আন্দ্রেয়া। অবশেষে স্কুটার চালিয়ে ইতালির মিলান থেকে আন্দ্রেয়া সাতক্ষীরার তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামে এসেছেন।
সাতক্ষীরা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রাম। পশ্চাৎপদ এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করেন। ১৪-১৫টি পরিবার ছাড়া গ্রামের সবারই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ মতো অবস্থা। সেই গ্রামে ইতালিয়ান নাগরিক আন্দ্রেয়া পুরোনো একটা ভেসপা চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে আন্দ্রেয়ার আমন্ত্রণে মিলান শহর থেকে গত ২৯ জানুয়ারি এক নারী এবং সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি এক পুরুষ মোটরসাইকেল চালিয়ে সাতক্ষীরায় এসেছেন। তাঁরা হলেন রোমানিয়ার নাগরিক এলেনা এক্সিনটের ও ইতালির নাগরিক ইলারিও লাভাররা। তাঁরা সবাই এখন অবস্থান করছেন হরিণখোলা গ্রামে।
ভিনদেশিদের আগমনে পুরো গ্রামে হইচই পড়ে গেছে। কাকুলি সরকার এই গ্রামের গোবিন্দ সরকারের মেয়ে। কাকুলিকে পড়াশোনার বিষয়ে সহযোগিতা করে ‘ঋশিল্পী ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। মূলত ঋশিল্পীর মাধ্যমেই কাকুলির সঙ্গে আন্দ্রেয়ার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। গত তিন বছর ধরে সাতক্ষীরার হরিণখোলা গ্রামের ওই শিশু কাকুলিকে শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করে আসছে আন্দ্রেয়া।
কাকুলির মা বিথিকা সরকার বলেন, তিন বছর আগে কাকুলির সঙ্গে চিঠি ও ছবির মাধ্যমে পরিচয় হলেও তাঁদের দেখা হয়নি। কাকুলিকে প্রথম দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন আন্দ্রেয়া। প্রথম দেখাতেই তিনি বলেন, ‘সম্ভব হলে আমি তোমার জন্য বাংলাদেশে থেকে যেতাম। আমি সব সময় খোঁজখবর নেব। এখন থেকে আমি সময় পেলেই তোমার কাছে চলে আসব।’
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কাকুলিদের বাড়িতেই দেখা হয় কাকুলির সঙ্গে। কাকুলি বর্তমানে বেসরকারি সংস্থা ঋশিল্পী ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত কমিউনিটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবার সম্বল বলতে পাঁচ শতক জমির ওপর আধাপাকা একটি বাড়ি। দুই বোনোর মধ্যে কাকুলি বড়। ছোট বোনের বয়স চার বছর। গোবিন্দ সরকার ও বিথিকা সরকার দুজনই কৃষিকাজ করেন। কোনো রকমে চলে তাদের সংসার।
বিথিকা সরকার বলেন, গত ৩ জানুয়ারি আন্দ্রেয়া তাঁদের বাড়িতে প্রথম আসেন। এ সময় আন্দ্রেয়া কাকুলিকে কোলে নিয়ে আদর করেন। পরে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেড়ান। এদিকে বিদেশি আসার খবরে তাঁদের বাড়িতে গ্রামের লোকজনের ভিড় জমে গিয়েছিল। সর্বশেষ ২৬ জানুয়ারি আন্দ্রেয়া সরস্বতী পূজার দিন এসেছিলেন। ওই দিন কাকুলিসহ গ্রামের অন্য শিশুদের সঙ্গে নিয়ে আন্দ্রেয়া ঘুরে বেড়ান।
ইতালির নাগরিক আন্দ্রেয়া পড়াশোনা করেছেন পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ইতালিতে বর্জ্য থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থায় কাজ করতেন তিনি। নিজের জমানো টাকা দিয়েই আন্দ্রেয়া ভ্রমণে বেরিয়েছেন।
আন্দ্রেয়া বলেন, গ্রামের সবুজ প্রকৃতি, মানুষ তাঁর খুব ভালো লেগেছে। মূলত কাকুলির আমন্ত্রণেই তিনি সাতক্ষীরায় এসেছেন। কাকুলি তাঁর মেয়ের মতো। যত দিন কাকুলি পড়াশোনা করতে চায়, তত দিনই তিনি সহযোগিতা করে যাবেন। বড় হয়ে কাকুলি ‘ভালো মানুষ’ হবে, মানুষের জন্য কাজ করবে, এটাই তিনি প্রত্যাশা করেন।
ইতালির মিলান শহর থেকে পাঁচ মাস আগে স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিলেন আন্দ্রেয়া। সাতটি দেশ ঘুরে গত ২৪ ডিসেম্বর ভারতের ঘোজাডাঙ্গা ইমিগ্রেশন দিয়ে সাতক্ষীরায় এসেছেন তিনি। পাকিস্তান ভ্রমণের সময় রোমানিয়ার নাগরিক এলেনা এক্সিনটেরের সঙ্গে আন্দ্রেয়ার পরিচয় হয়। এলেনা রোমানিয়ার নাগরিক হলেও বাস করেন ইতালির মিলান শহরে। এলেনার পরিবারে মা ও এক বোন আছে। মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো তাঁর শখ। তবে এলেনা পেশায় একজন মঞ্চ অভিনেতা। মিলান শহর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট যাত্রা শুরু করেন তিনি। এই সাড়ে তিন বছরে তিনি ২৮টি দেশ ঘুরেছেন।
বিশাল আকৃতির হারলে ডেভিডসন আয়রন ৮৮৩ সিসি মোটরসাইকেল নিয়ে এলেনা ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট যাত্রা শুরু করার আগে এই মোটরসাইকেলেই তিনি আফ্রিকার সাতটি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। এলেনা বলেন, আন্দ্রেয়ার অনুরোধে তিনি কাকুলিকে দেখতে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে এসে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। তাঁর ভিসার মেয়াদ আর এক মাস আছে। পুরো সময়টাই তিনি বাংলাদেশ থাকবেন। প্রয়োজনে ভিসা মেয়াদ বাড়াতেও পারেন।
আন্দ্রেয়া ও এলেনার আমন্ত্রণে সর্বশেষ ভেসপা চালিয়ে সাতক্ষীরায় আসা আরেকজন হলেন ৪০ বছর বয়সী ইলারিও লাভাররা। ইতালিয়ান ইলারিও অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। ইলারিও ইতিমধ্যে ৯৭টি দেশ ঘুরেছেন। এর আগে ২০১০-১২ সালে আমেরিকার ২১টি দেশ ঘুরে ‘টোয়েন্টি আমেরিকান বুকস’ নামের একটি বই লিখেছেন। ইলারিও বলেন, ইতালিতে ফিরে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেকটি বই লিখতে চান তিনি।
কাকুলির দাদি অরুণা সরকার বলেন, আন্দ্রেয়ার আগমনে তাঁরা খুবই খুশি। তাঁর নাতনিকে পড়াশোনার জন্য একজন ভিনদেশি পাশে দাঁড়িয়েছেন। এতে তিনি আন্দ্রেয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ। কাকুলি পড়াশোনা শিখতে পারলে সমাজ আলোকিত করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
ঋশিল্পী ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ভিনসেনজো ফালকনো বলেন, এই সংস্থার মধ্যে ৩৫টি কমিউনিটি বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ ছাড়াও স্কুল পোশাক, জুতা ও ব্যাগ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। আন্দ্রেয়ার মতো পরোপকারী ব্যক্তিরা ঋশিল্পী ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করেন।