হুইলচেয়ারের আদলে তৈরি ব্যাটারিচালিত বিশেষ গাড়ি চালিয়ে ময়মনসিংহ শহরে আসেন চাকরিপ্রত্যাশী শারীরিক প্রতিবন্ধী ফারুক আহমেদ। তাঁর বাড়ি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামে। সাধারণত ইঞ্জিনচালিত বাহনে এতটুকু পথ আসতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। কিন্তু ফারুকের এই পথ আসতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁকে ধীরে ধীরে গাড়িটি চালাতে হয়েছে।
ময়মনসিংহ নগরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের সামনে ফারুক আহমেদ যখন পৌঁছান, তখন ৯টা ৩৫ মিনিট। ১০টায় শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। পৌঁছাতে একটু দেরি হওয়ায় কেন্দ্রে প্রবেশের সময় জেরার মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। এভাবেই জীবনের শেষ চাকরির পরীক্ষাটি দেন ফারুক। পরীক্ষার পর আবারও গাড়িটি চালিয়ে ফিরছিলেন নিজ গ্রামে। ময়মনসিংহ নগরের নতুন বাজার এলাকায় দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। কুশল বিনিময়ের সময় অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘আপনাদের পত্রিকায় (প্রথম আলোতে) আমাকে অদম্য ফারুক আখ্যা দিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছিল। আমি এখন হেরে গেছি। অদম্য আখ্যাটা ফিরিয়ে নেন।’
এরপর কিছুটা স্থির হয়ে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন ছিল ছোটখাটো একটি সরকারি চাকরি করে জীবনটা পাড়ি দেব। কিন্তু অনেক চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিলেও মেলেনি চাকরি। এটাই জীবনের শেষ চাকরির পরীক্ষা। কারণ, বয়স শেষ।’ তিনি আরও বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আবেদন করার পরও অনেক চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। ঢাকায় পরীক্ষা হলেও আবেদন করার পরও পরীক্ষায় অংশ নিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।
ফারুক আহমেদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, মাত্র দেড় বছর বয়সে পোলিও রোগে দুটি পায়ের শক্তি হারান তিনি। তারপরও স্বপ্ন থেমে যায়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজে।
প্রতিদিন তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রাম থেকে ব্যাটারিচালিত গাড়িটি নিজেই চালিয়ে আসতেন কলেজে।
২০১৬ সালে ফারুক আহমেদ শেষ করেন স্নাতকোত্তর। এরপর শুরু হয় চাকরির চেষ্টা। পাশাপাশি নিজের বাড়িতে শিশুদের জন্য একটি স্কুল করেন। শিশুদের স্কুল আর একটি সরকারি চাকরির স্বপ্নে সময় ভালোই কাটছিল। ফারুকের স্কুলের নাম এম আর শিক্ষা সংবাদ স্কুল। এই স্কুলে গ্রামের শিশুদের পড়ানো হয়। সামর্থ্যবান পরিবারের শিশুদের কাছ থেকে মাসিক বেতন আদায় করা হলেও দরিদ্র শিশুরা পড়ে বিনা বেতনে। স্কুল নিয়ে ফারুকের স্বপ্ন ছিল গ্রামের শিশুরা যেন ভালো করে শিক্ষা নিতে পারে। নিজের একটি সরকারি চাকরি হলে স্কুলটি আরও বড় পরিসরে চালানোর ইচ্ছা ছিল। ফারুকের এমন স্বপ্নের কথা জানতে পেরে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অদম্য ফারুকের পাঠশালা’ নামে প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
চাকরি না হওয়ায় ক্রমেই তাঁর স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করে। ভর করতে থাকে হতাশা। আজ শুক্রবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার পর ফারুক আহমেদ বললেন, আনন্দ মোহন কলেজে ২০০৬-০৭ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হন। ২০১১ সালে চার বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেশনজটের কারণে তা শেষ হয় ২০১৪ সালে। স্নাতকোত্তর শেষ হয় ২০১৬ সালে। এর পর থেকে চাকরির জন্য পরীক্ষায় আবেদন করে যাচ্ছেন। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তিনি নিয়মিত পড়াশোনা ও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। অনকে সময় পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়েও বহুতল ভবনে আসন পড়ায় পরীক্ষা না দিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
সনদ অনুযায়ী চাকরির আবেদনের বয়স শেষ হয়ে গেছে জানিয়ে ফারুক বলেন, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩০ বছর হলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তাঁর জন্য বয়সসীমা ৩২ বছর। আজ তিনি জীবনের শেষ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এবারও হয়তো মিলবে না চাকরি।