বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ১১ জনের মধ্যে ৯ জনেরই লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। সুষ্ঠু বিচার নিয়ে শঙ্কা।
হবিগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে প্রাণ হারান ১১ জন। এর মধ্যে মাত্র দুজনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। বাকি নয়জনের ময়নাতদন্ত না করে লাশগুলো নিয়ে যান স্বজনেরা। এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে থানায় মামলা হলেও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করায় সুষ্ঠু বিচার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না থাকলে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা কঠিন হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার কোনো ব্যক্তির লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হচ্ছে ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও বিচারের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গুলিবিদ্ধ বা অন্যভাবে মারাত্মক জখমে গত ৫ আগস্ট বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নয়জনের মৃত্যু হয়। তাঁদের অনেককে আনা হয় মৃত অবস্থায়, আবার অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মারা যাওয়া সবার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনেরা নিয়ে যান বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শামীমা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশকে জানানো হলেও তারা আসেনি। ফলে বাধ্য হয়ে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
২ আগস্ট হবিগঞ্জ জেলা সদরে আওয়ামী লীগ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে মোস্তাক মিয়া ও ৪ আগস্ট রিপন শীলের মৃত্যু হয়। তাঁদের লাশ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এই দুজন ছাড়া আর কারও ময়নাতদন্ত এ হাসপাতালে হয়নি।
৫ আগস্ট বানিয়াচংয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে মারা যাওয়া নয়জন হলেন উপজেলার যাত্রাপাশা মহল্লার হাসান মিয়া (১২), মাঝের মহল্লার আশরাফুল ইসলাম (১৭), পাড়াগাঁও মহল্লার মোজাক্কির মিয়া (৪০), কামালহানি মহল্লার নয়ন মিয়া (২০), যাতুকর্নপাড়া মহল্লার তোফাজ্জল (১৮), পূর্বঘর গ্রামের সাদিকুর (৩০), কামালখানি গ্রামের আকিনুর মিয়া (৩২), খন্দকার মহল্লার আনাছ মিয়া (১৮) ও সাগরদীঘি পূর্ব পাড়ের সোহেল আখঞ্জী (৩৫)।
এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ১৬০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ৩০০ জনকে। পাশাপাশি হবিগঞ্জ জেলা সদরে মোস্তাক আহমেদ ও রিপন শীল হত্যার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরকে প্রধান করে প্রায় ৩০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত না হওয়ার বিষয়ে নিহত তোফাজ্জলের বাবা আবদুর রউফ বলেন, ময়নাতদন্ত করার দায়িত্ব ছিল পুলিশের। কেন তারা করেনি, এটা তাঁদের জানা নেই। ঘটনার দিন লাশগুলো হাসপাতালের বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে ছিল। তখন অন্য স্বজনেরা লাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরলে তিনিও ছেলের লাশ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন।
ময়নাতদন্তের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি উল্লেখ করে বানিয়াচং থানার পরিদর্শক তদন্ত আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, নয়জন নিহতের বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। কীভাবে তাঁরা মারা গেছেন, বিষয়টি সবারই জানা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশের প্রবিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ামাত্র পুলিশ লাশ দেখতে যাবে। এরপর মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহ পাঠাতে হবে ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে। পিআরবির ২৯৯ ধারা অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ৪৮ নম্বর ফরমে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবে। তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেস ডায়েরি তৈরি করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুনের মামলার অন্যতম সাক্ষ্য।
জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে হবে। ময়নাতদন্ত না হলে ওই মৃত্যুর আসল কারণ তুলে ধরা যাবে না আদালতে।
হবিগঞ্জের নবাগত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা প্রমাণ করতে হলে অবশ্যই এ লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করতে হবে।