জমিদারদের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া। এবার ঈদুল ফিতরের ১৯৬তম জামাত হবে এই মাঠে। গত বুধবারের ছবি
জমিদারদের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া। এবার ঈদুল ফিতরের ১৯৬তম জামাত হবে এই মাঠে। গত বুধবারের ছবি

হাওরের জমিদারদের ঈদগাহ শোলাকিয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে যেভাবে

‘ছয় থেকে সাত বছর বয়স থেকে এ মাঠে নামাজ আদায় করছি। সে হিসাবে, ৭০ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়ি। তখন থেকে আমরা এ মাঠে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতি দেখে আসছি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি, এ মাঠে জমিদারেরা ঈদের নামাজ আদায় করতেন। যত দূর মনে পড়ে, ছোটবেলায় জমিদারদের পরিবারের সদস্যদের ঘোড়ার গাড়িতে সিংহাসন বসিয়ে এবং সাজানো নৌকায় করে এ মাঠে নামাজ আদায়ে আসতে দেখেছি।’

৭৬ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন গত বুধবারও কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করেন। এরপর মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে ফেরার সময় এ প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন তিনি।

আনোয়ার হোসেনের মতো ষাটোর্ধ্ব নুরুল ইসলামের বাড়িও শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ-লাগোয়া। তিনি বলেন, ৬০ বছর ধরে এ মাঠে নামাজ আদায় করে আসছেন। ছোটবেলা থেকে এ মাঠে দূরদূরান্তের মুসল্লিদের ঈদের জামাতে অংশ নিতে দেখে আসছেন।

এবার শোলাকিয়ায় পবিত্র ঈদুল ফিতরের ১৯৬তম জামাত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে ঈদের জামাত আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

শোলাকিয়ায় ঈদুল ফিতরের জামাত আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে

স্থানীয় অন্তত ১০ জন প্রবীণের সঙ্গে কথা বলে ও কিশোরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, ধর্ম প্রচারের জন্য দেশের বাইরে থেকে এ দেশে আসেন সৈয়দ আহাম্মদ (রহ.) নামের একজন ধর্মপ্রচারক। প্রথম এ মাঠে ঈদের নামাজের ইমামতি করেন তিনি। থাকতেন বীর ঈশা খাঁর বংশধর হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেওয়ানবাড়িতে। তখন থেকেই এ মাঠে নামাজ আদায়ের প্রচলন ঘটে। সে হিসাবে এ মাঠের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও ১৯৫০ সালে দেওয়ান মান্নান দাদ খান সাড়ে তিন একর জমি এ মাঠের নামে ওয়াক্ফ করে দেন।

বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খাঁ কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এ ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাঠের জমির পরিমাণ আরও বাড়ানো হয়। দেওয়ান মান্নান দাদ ছিলেন হয়বত খাঁর বংশধর। হয়বত খাঁ ছিলেন ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর। যে কারণে শুরু থেকে এ মাঠের জমিদারির একটা ঐতিহ্য রয়েছে।

বন্দুকের গুলির আওয়াজের মাধ্যমে ঈদের দিন সকাল ১০টায় শোলাকিয়ার জামাত শুরু হবে

এটা তৎকালীন জমিদারের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ছিল বলে জানান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের স্থানীয় বাসিন্দা মো. খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তাঁর বাবা আতাউর রহমান খানের কাছ থেকে শুনেছেন, জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খান ঘোড়ার গাড়িতে সিংহাসন বসিয়ে বাহিনী নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এ মাঠে নামাজ পড়তে আসতেন। এ ছাড়া ইটনা হাওরের জমিদারসহ বিভিন্ন এলাকার জমিদারেরা নৌকা সাজিয়ে এ ঈদগাহে নামাজ পড়তে আসতেন। জমিদারদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন বলে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজন জড়ো হতেন মাঠে। এভাবেই এ মাঠের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

ইতিহাসের বই ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ধর্মপ্রচারক সৈয়দ আহাম্মদ (রহ.)-এর মৃত্যুর পর এ মাঠে ধারাবাহিকভাবে ইমামতি করেন তৎকালীন শোলাকিয়া সাহেববাড়ি ও হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির মসজিদের ইমাম এবং হয়বতনগর এ ইউ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষরা। তবে হয়বতনগর এ ইউ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল খায়ের মো. নূরুল্লাহ মারা যাওয়ার পর থেকে এ ধারাবাহিকতার ছন্দপতন ঘটে।
লেখক মু. আ লতিফের লেখা ‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য’ বইয়ে শোলাকিয়া মাঠ নিয়ে দুটি জনশ্রুতির বর্ণনা রয়েছে। এর একটি হলো, মুঘল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল শ লাখ টাকা। মানে এক কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে শ লাখ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া হয়েছে। আরেকটি জনশ্রুতি হলো, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এটি শোয়ালাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

শোলাকিয়ার ৬ দশমিক ৬১ একর আয়তনের ঈদগাহের মূল মাঠে ঈদের জামাতে প্রায় আড়াই শ কাতার থাকে

এবার জামাত শুরু সকাল ১০টায়

এরই মধ্যে এবারে ঈদুল ফিতরের জামাতের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ। বন্দুকের গুলির আওয়াজের মাধ্যমে ঈদের দিন সকাল ১০টায় জামাত শুরু হবে। এতে ইমামতি করবেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ঈদের জামাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য আগত মুসল্লিদের মাঠে ছাতা ও মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশলাইসহ দাহ্য বস্তু বহন না করার বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদ সূত্র জানায়, শোলাকিয়ার ৬ দশমিক ৬১ একর আয়তনের ঈদগাহের মূল মাঠে ঈদের জামাতে প্রায় আড়াই শ কাতার থাকবে। প্রতিটি কাতারে ৫০০ থেকে ৬০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচ প্লাটুন বিজিবিসহ পুলিশ, র‍্যাব ও আনসার সদস্যদের নিয়ে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ধাতব বস্তু শনাক্তকরণ যন্ত্র (মেটাল ডিটেক্টর) দিয়ে তল্লাশি করে প্রত্যেক মুসল্লিকে মাঠে ঢোকানো হবে।

২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর থেকে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের দুটি বিশেষ ট্রেন চালু থাকবে। কয়েকটি ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হবে পুরো মাঠ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য থাকবে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার।